গরমের সেই ভর দুপুরে টিনের চালে আম পড়লেও ঠাকুমা বলতেন ভূতে ঢিল ছুঁড়েছে। মাঝ রাতের আলো আধারিতে নুপুরের রিনিঝিনি, হাতে হারিকেন কিংবা মোমমাবি নিয়ে ভূত পেত্নির নৃত্য, শেওড়া গাছে পা ঝুলিয়ে হিহি হাসি, মা-ঠাকুমাদের মুখে এরকম হাজার গল্প শুনে ছেলেবেলার দিন কেটেছে। তবে, গল্প শুনে ভয় পাবার দিন এখন আর নেই। ভয় এখন অন্য উপায়ে আসে। ভূত এখন হাজির হয় সিনেমায়। দরজা জানালা বন্ধ করে, ঘরের লাইট অফ করে অন্ধকার রাতে চুপচাপ বসে ভয়ের সিনেমা দেখে গলা শুকিয়ে ফেলি, হাত প ঠনঠন করে কাঁপতে থাকে, শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। তবু আমরা বারবার এই লোমহর্ষক কিংবা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নিতে চাই। কারণ আমরা ভয় পেতে ভালোবাসি। তবে, এই অনুভূতিট্ব যখন ভয়ের চেয়ে বেশি কিছু তৈরি করে, তখনই শুরু হয় হরর সাইকোপ্যাথকে ছাড়িয়ে একটা ধারার। যেখানে ভয়ের অনুভূতির চেয়ে ঘৃনা আর যন্ত্রনার উপলব্ধিই প্রবল হয়ে ওঠে। সাইকোথ্রিলারে যদি কাউকে সম্রাট বলে ভাবতে হয়, তিনি আর কেউ নন, আলফ্রেড হিচকক। হিচককের পর আরো অনেকেই সাইকোথ্রিলার আর হরর নিয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করেছেন। তবে সবাই সফল হতে পারেননি। তবে, এ ধারার বিশেষায়িত দর্শকও আছে অনেক। এই ধারার সিনেমা পরিচালকদের মাঝে একজন হলেন লি’ ওয়াহনেল।
চলচ্চিত্র হল সবচেয়ে বড় বিনোদন মাধ্যমেগুলোর একটি। একটি চলচিত্রে শুধু অর্থ লগ্নি করলেই হয় না, সাথে দরকার আর্কষনীয় গল্প এবং তা উপস্থাপনের সঠিক দক্ষতা কলা-কুশলী। সব কিছু মিলিয়েই নির্মিত হয় ভাল চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রের একটা নিজস্বভাষা আছে, আছে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। পরিচালক নিজের মনের জানালা দিয়ে যা দেখছেন তাই ফুটিয়ে তুলতে চান তার সিলভার স্ক্রিনে। লি’ ওয়াহনেল হচ্ছেন সেরকম একজন নির্মাতা। একাধারে যিনি একজন চরিত্রাভিনেতা, চিত্রনাট্যকার, পরিচালক এবং প্রযোজক। অস্ট্রেলিয়ান এই নির্মাতা স’ (SAW) ফ্রাঞ্চাইজি নির্মানের পেছনের মূখ্য কারিগর। স’ এর প্রথম কিস্তির লেখক ছিলেন তিনি নিজে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় কিস্তির সহ-লেখক। সবগুলো চলচ্চিত্রের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্বও পালন করেন এই মানুষটিই। সেই সাথে তৈরি করেছেন আরো একটি ভুতুরে গল্পের চলচ্চিত্র, যার নাম ইনসিডিয়স।
সম্প্রতি, তিনি সিন্ধান্ত নিয়েছেন সাইকোথ্রিলার আর হরর থেকে সরে গিয়ে নির্মান করবেন সাইবোর্গ হরর চলচ্চিত্র। সাইবোর্গ হচ্ছে এমন একটা প্রজাতি যার অর্ধেকটা মানুষ আর অর্ধেকটা যন্ত্র। গ্রীক পুরানে যেমন আছে সেন্টার (অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক ঘোড়া), অনেকটা সেরকম। এই সাইবোর্গের কথা সর্বপ্রথম মানুষের সামনে এনেছিলেন বিখ্যাত গল্পকার এগডার এ্যালেন পো। সে প্রায় আজ থেকে ১৭৫ বছর আগে। আর এখন এই আধা মানুষ আধা-যন্ত্র আমাদের সামনে হেঁটে বেড়াচ্ছে চলচ্চিত্রের পর্দায়। লি’ নিয়ে এসেছেন এমনই এক সাইবোর্গ থ্রিলার গল্প যার নাম ‘আপগ্রেড’। এই গল্প একজন স্থবির মানুষের, যিনি লড়ছেন প্যারালাইসিস এর সাথে। সেখানে একটা কম্পিউটার চিপ তাকে ক্ষমতা দেয় হাঁটা চলার আর এখই সাথে তার প্রিয়তমা স্ত্রীর হত্যাত প্রতিশোধ নেবার। এরপর গল্প এগিয়ে চলেছে তার নিজের নিয়মে। লি’ ওয়াহনেলকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি সহজ ভাষায় বলেন “আমি মানুষের প্রযুক্তির থেকে মানুষ সম্পর্কেই বেশি চিন্তিত।”
আপগ্রেড ছবির গল্পটা আর দশটা সাইফাই সিনেমার থেকে কিছুটা আলাদা। অন্তত লি’ এর জনরার থেকে তো আলাদা বটেই। সাইবোর্গ নিয়ে কাজ করেছেন। যেমন দ্যা সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান, স্টার ওয়ার্সের ডার্থ ভ্যাডের ইত্যাদি। তবে আপগ্রেড ছবিটি সকলকে ছাড়িয়ে গিয়েছে এর গল্পের গাঁথুনি আর ভিতের উপর ভর করে। লি’ ব্যাক্তি জীবনে বারবার প্রযুক্তি নিয়ে বিরক্ত। তার বিশ্বাস স্মার্টফোন হলো দুশ্চিন্তার আরেক নাম। আর অন্যদিকে ম্যাসেঞ্জার হলো একটা সমস্যা। তিনি জানান, অনেকেই ভাবেন স্মার্টফোন বা এ ধরনের টেকনোলজি হয়তো উন্নত বিশ্বের সমস্যা। সিরিয়ায় যে মানুষটি যুদ্ধে মাঝে দিন কাটাচ্ছে তার কাছে হইতো টুইটারের আবেদন নেই। তবে, এটা ভুলে গেলে চলবেনা, ওই বোমা মারার খবর আমাদের কাছে আসছে এই টেকনোলজির মাধ্যমেই। তাই যন্ত্রের যন্ত্রনা থেকে দূরে থাকতে চান লি’। তবুও তিনি সাইবোর্গদের পছন্দ করেন। তাঁর মতে সাইবোর্গদের মাঝেও ভালোর অস্তিত্ব আছে। সাইবোর্গভিত্তিক আরো ছবি নির্মানের পেছনে তিনি আর থাকবেন কিনা বলা যাচ্ছে না। তবে, বড় বিষয় হলো তিনি তার ভয়ের গল্প থেকে বের হয়ে চেয়েছেন। একটা নতুন গল্প বলতে চেয়েছেন। এই সিনেমা শুধু একটা প্রতিশোধর গল্প বলে না। লি’ এখানে একটা আশাও দেছিয়েছেন। একদিন হয়তো চলন প্রতিবন্ধী মানুষ উঠে দাঁড়াবে নিজের পায়ে সেই স্বপ্নের কথাও বলে এই সিনেমা। লি’ এর লেখা আর পরিচালনায় এই ছবি জনপ্রিয়তাও পেয়েছে বেশ। ৯৫ মিনিটের এই ছবিটির আইএমডিবি’র রেটিং ৭,৮/১০। আর বক্স অফিসে আয় করেছে ১২ মিলিয়ন ডলার।
এখন এখন শুধু জানার লি’ কি স’ এর মতো আরো নৃশংস ছবি বানাবেন? প্রশ্নটা সময়ের কাছে তোলা রইলো।
ছবিসত্ব: ইন্টারনেট সূত্র থেকে সংগৃহীত