আধুনিক সিনেমা মানেই হচ্ছে ডিজিটালাজাইড সিনেমা। ফিল্ম রীল এর পরিবর্তে ধারণকৃত চিত্র জমা হচ্ছে ডিজিটাল স্টোরেজে। রীল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চিত্র ধারণের পরিবর্তে এখন ডিজিটাল ক্যামেরার নব ঘুরিয়েই কাজ হচ্ছে নিমিষেই। আগে চিত্র সম্পাদনার কাজ করা হতো ফিল্মগুলো কেটে একটির সাথে আরেকটিকে জোড়া লাগিয়ে। আর এখন? যা দিয়ে চিত্র ধারণ করা হচ্ছে, তাতেই চিত্রগুলো মজুদ রেখে আবার সেটা দিয়েই সম্পাদনার কাজ সেরে নেয়া হচ্ছে। এ তো গেলো আধুনিক সিনেমার সহজ পরিচয়। এখন শুধুমাত্র চিত্র ধারণ করে সম্পাদনা করলেই কিন্তু সিনেমা হয়ে যাচ্ছে। তবুও, গল্পের প্রয়োজনে আরও বিশেষ কিছু অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। ধরুন, আপনার গল্পে একটি কাল্পনিক জগত আছে, কিন্তু তার কোন বাস্তব অস্তিত্ব নেই। এখন আপনি সেই কাল্পনিক জগতকে কিভাবে দৃশ্যমান করে তুলবেন? সেজন্য আছে ডিজিটাল প্রযুক্তির সংযোজন কম্পিউটার জেনারেটেড ইমেজ, সংক্ষেপে যাকে বলে সিজিআই বা ভিজ্যুয়াল ইফেক্টস, অথবা ভিএফএক্স। একটা বড়সড় স্টুডিওতে গিয়ে গ্রিন স্ক্রিনে প্রয়োজনীয় চিত্র ধারণ করে নিয়ে এসে সিজিআই বা ভিএফএক্স ব্যবহার করে সম্পাদনা করলেই সিনেমাটা হয়ে যাচ্ছে। এই যে এনালগ থেকে ডিজিটালে পদার্পণ করে গল্পকে নতুন ভাবে, নতুন আঙ্গিকে বলার যে প্রচেষ্টা এরই নামই হচ্ছে ডিজিটাল নন্দনতত্ত্ব।
গত শতকের শেষ দশকে এসে সিনেমা ডিজিটাল রূপ নিতে শুরু করে। “রেইনবো (১৯৯৬)” হচ্ছে প্রথম উল্লেখযোগ্য সিনেমা যার চিত্রগ্রহণ, শব্দ সম্পাদনা, চিত্র সম্পাদনা, এবং বিন্যাসের পুরো কাজটাই করা হয়েছে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে। “টয় স্টোরি ২ (১৯৯৯)” নির্মাণে ক্যামেরার পরিবর্তে আধুনিক কম্পিউটার জেনারেটেড ইমেইজ বা সিজিআই ব্যবহার করা হয়েছিলো। ডিজিটাল প্রযুক্তিতে সিনেমা নির্মাণের পাশাপাশি সিনেমা প্রদর্শনের জন্য ডিজিটাল প্রজেক্টর ব্যবহার শুরু হয়। জর্জ লুকাস এর “স্টার ওয়ার্সঃ ইপিসড ১ – দ্যা ফ্যানটম ম্যানাস” সিনেমাটি প্রদর্শনের জন্য
চারটি থিয়েটারে ডিজিটাল প্রজেক্টর স্থাপন করা হয়েছিল। এবার আসা যাক সিনেমায় প্রযুক্তিক নান্দনিকতা প্রসঙ্গে। ডিজিটাল সিনেমার একেবারের শুরুর দিকে অবস্থায় একে আরও প্রসারিত এবং সিনেমা নির্মাণে ডিজিটাল প্রযুক্তির উপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য বেশকিছু পরীক্ষামূলক কাজ করা হয়।
তার মধ্যে একটি বিশেষ কাজ হচ্ছে আলেক্সান্দার সুকোরোভ নির্মিত “রাশিয়ান আর্ক (২০০২)”। প্রায় দুই ঘন্টার এই সিনেমার পুরো চিত্রগ্রহণ হয়েছিলো একটি মাত্র লং টেকে। এভাবে ডিজিটাল প্রযুক্তির সুবাদে সিনেমায় গল্প বলার ভঙ্গিতে বিভিন্ন মাত্রা যুক্ত হতে থাকে ক্রমান্বয়ে। “টাইমকোড (২০০০)” এমনই আরেকটি পরীক্ষামূলক কাজ। যেখানে, একসঙ্গে চারজন চিত্রগ্রাহক ধারাবাহিকভাবে চারটি আলাদা আলাদা চিত্রগ্রহণ করেন এবং স্ক্রিনকে চারভাগে ভাগ করে প্রত্যেক অংশে সেই ধারণকৃত চিত্রগুলো প্রদর্শিত হয়। অর্থাৎ, একই সময়ে চারটি পৃথক ঘটনা দেখানো হচ্ছে একই সঙ্গে একটি স্ক্রিনে।
ডিজিটাল প্রযুক্তি হাতে আসার পর থেকে সিনেমা নির্মাণে এসেছে বৈচিত্রতা। ভিডিও ফুটেজ থেকে একটি বা কয়েকটি নির্দিষ্ট চরিত্রকে বা পুরো ঘটনাকে পুনর্গঠন করে তা দিয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে অ্যানিমেটেড তথ্যচিত্র যার চরিত্রগুলোকে দেখলে একেবারেই অবাস্তব মনে করার কোন সুযোগ ই নেই। “শিকাগো ১০ঃ স্পিক ইউর পিস (২০০৭)” এই আমেরিকান অ্যানিমেটেড তথ্যচিত্রটি নির্মাণ করা হয় শিকাগোর সাতজন প্রতিবাদীদের আদালতের বিচার নিয়ে যারা ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলন এবং দাঙ্গা সংঘটন প্রণোদিত করার দায়ে অভিযুক্ত ছিলো। এখানে পুরো ঘটনাকে পুনর্গঠন করার জন্য সেই বিচারের অনুলিপি, অডিও রেকর্ডিং, এবং অভিযুক্তদের, আন্দোলনের ও দাঙ্গার কিছু আর্কাইভাল ফুটেজও ব্যবহার করা হয়৷ বিশেষত, এখানে যে প্রযুক্তিটি ব্যবহার করা হয়েছিলো তার নাম হচ্ছে রোটোস্কোপিং।এ পদ্ধতিতে কোনো ফুটেজ বা ছবির উপর স্বচ্ছ কাগজ বা কাঁচ বসিয়ে তার উপর ঐ ফুটেজ বা ছবির অনুরূপ করে খসড়া আঁকা বা ট্রেসিং করা হয়। এরকমই আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে ’ “ওয়ালটস উইথ বাশির (২০০৮)”। ইসরায়েলি এই অ্যানিমেটেড তথ্যচিত্রটি লেবানন যুদ্ধে স্বয়ং পরিচালক এরি ফোলম্যান এর সৈনিক হিসেবে দায়িত্ব পালনরত অবস্থার স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা নিয়ে নির্মিত হয়।
সিনেমায় ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বর্তমানে অনেক সুদূরপ্রসারী হয়েছে। বিশাল অংকের বাজেট নির্ধারণ করা হচ্ছে শুধুমাত্র উন্নত প্রযুক্তি দিয়ে সিনেমা তৈরির লক্ষ্যে। ২০০৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত “অ্যাভাটার” সিনেমায় তখনকার সময়ে ডিজিটাল প্রযুক্তির সর্বোচ্চ প্রয়োগ করা হয়েছিলো। পরিচালক জেমস ক্যামেরুন উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারে কোন কার্পণ্য করেননি। সম্পূর্ণ ডিজিটাল ক্যামেরায় চিত্রধারণ থেকে শুরু করে ত্রি–মাত্রিক প্রযুক্তি ও মোশন ক্যাপচার প্রযুক্তির ব্যবহার দেখা যায় “অ্যাভাটার” এ। বলা যায়, “অ্যাভাটার” ডিজিটাল নন্দনতত্বের একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। এখানে, সংক্ষিপ্ত করে মোশন ক্যাপচার সম্পর্কে একটু বলে রাখি। মোশন ক্যাপচার বা মো–ক্যাপ হচ্ছে একটি প্রক্রিয়া যেখানে কোন ব্যক্তি বা বস্তুর নড়াচড়া, চলাফেরা বা গতিবিধি রেকর্ড করে রাখা হয় এবং পরবর্তীতে সেগুলো সিনেমা ও ভিডিও গেইম তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। উদাহরণ হিসেবে, “কিং কং” এর “কিং কং”, “লর্ড অব দা রিংস” এর “গোলেম” কিংবা “দ্য হবিট” এর “স্মাউগ” চরিত্রগুলোর কথা বলা যায় যেগুলো মোশন ক্যাপচার প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। বর্তমানে মোশন ক্যাপচার প্রযুক্তিটি অনেক উন্নত হয়েছে এবং এর ব্যবহার লক্ষণীয়ভাবে বেড়েই চলছে।
সিনেমা আজ প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে এমন এক অবস্থানে পৌঁছেছে যেখান থেকে আর পেছনে না ফিরে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে এর যাত্রা। ডিজিটাল প্রযুক্তি পরিচিতি পাবারও অনেক আগে একজন চিত্রনাট্যকার অথবা একজন পরিচালকের চিন্তা করার সীমা খুব প্রসারিত ছিল না। তাদের ভাবনাগুলো খুব সংকুচিত হয়ে আসছিলো। যে কারণে সকলের কাজ প্রায় একই ঘরানার হতো। মূলধারার বাহিরে এসে চিন্তা করতে হিমশিম খেতে হতো তাঁদের কারণ নিরুপায় ছিলেন তাঁরা। প্রয়োজনের অনুভব থেকেই ডিজিটাল প্রযুক্তির আগমন ঘটেছে এবং এর বহুমাত্রিক ব্যবহার ও নান্দনিকতাই ছিল এর গন্তব্য। আজকের প্রয়োজনে আগামীতে কী আসবে সিনেমা জগতে এবং এর গন্তব্য কতটুকু হবে সেটা জানতে হলে সিনেমা নিয়ে ভাবতে হবে, এর সাথেই হাঁটতে হবে ।
ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত