চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক ও সংগঠক বেলায়াত হোসেন মামুন। তিনি ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটি-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি। তিনি বর্তমানে ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক। তিনি চলচ্চিত্র বিষয়ক দুটি পত্রিকা ‘ম্যুভিয়ানা’ ও ‘চিত্ররূপ’ এর সম্পাদক। এছাড়া তাঁর লিখিত চলচ্চিত্র বিষয়ক ৬টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি নির্মাণ করেছেন ৩টি প্রামাণ্যচলচ্চিত্র। সর্বস্তরে চলচ্চিত্র শিক্ষার প্রসারে এবং দেশে স্বাধীন চলচ্চিত্র আন্দোলনের তৎপরতায় তিনি সক্রিয়তম ব্যক্তি।
সিনেমাস্কোপের পত্রিকা ‘সিনেপিডিয়া’র জন্য তাঁর এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ ও শ্রুতিলিখন করেছেন ‘সিনেপিডিয়া’র সম্পাদক মো. হাসানুজ্জামান।
প্রশ্ন: বিষয়বস্তু এবং আঙ্গিকের দিক থেকে আজকের সিনেমাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
বেলায়াত হোসেন মামুন: কয়েকদিন আগে খবরে দেখলাম, ৯৩টি দেশ থেকে এবার অস্কার এর জন্য ছবি পাঠানো হয়েছে, তারমানে পৃথিবীর ৯৩টি দেশে রেগুলার সিনেমা হচ্ছে, এ সব দেশে সিনেমাহল আছে, ফিল্ম কালচার আছে, এটলিস্ট এ সব আমরা ধরে নিতে পারি। এভাবে দেখলে এটাকে অনেক বড় একটা এরিয়া মনে হবে। আমি আমার পছন্দের জায়গা থেকে কথা বলতে পারি, কারণ যে প্রশ্ন করেছেন সে প্রশ্নের উত্তর অনেক দিক দিয়ে দেয়া যেতে পারে এবং এই প্রশ্নটা অনেকটা ওপেন ইন্ডেড প্রশ্ন।
প্রত্যেকটা দেশে বিভিন্ন ধরনের সিনেমা হয়, ৯৩ টা দেশে যে চলচ্চিত্র হচ্ছে, তাদের মধ্যে নানা ধরনের চেষ্টা আছে। প্রত্যেকটা জিনিস আলোচনার যোগ্য, আলোচনা করা বা হওয়া উচিৎ তাই এই এরিয়াটা অনেক বড়। আমার কাছে মনে হয় যে, আমি কিছুদিন আগে একটি ছবি দেখেছি যেটা দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি এবং এটা গতবছরের ঘটনা; ছবিটার নাম ‘লর্ড অফ দ্য অরফেন্স,’ ভারতের বিশিষ্ট চলচ্চিত্রগ্রাহক রঞ্জন পালিত ছবিটা নির্মাণ করেছেন। ইটস এ কাইন্ড অব ডকুমেন্টারি বাট ফিকশন, ডকুফিকশন ধরনের এবং রঞ্জন পালিত তার নিজের জীবন, তার পরিবার এর জীবন, তার তিনপুরুষকে নিয়ে ছবিটার টাইমলাইন সাজিয়েছেন। তার গ্রান্ডফাদার, তার বাবা এবং তার নিজের জীবনকে সে একটা ছবিতে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছে। এই ছবিটার যে আঙ্গিক, সেটা আমার মনে হয়েছে যে, এটা এই সময়ের চলচ্চিত্রের ভাষায় আমি যত ধরনের কাজ দেখেছি তার মধ্যে আমার কাছে ওনার এই ভাষা অসাধারণ লেগেছ।
উনি ছবি তৈরি করতে আইফোন, মোস্টলি হ্যান্ডিক্যাম বা এ ধরনের ক্যামেরা দিয়ে শুট করেছেন। এবং খুবই পার্সোনাল ধরনের মানে আমরা পার্সোনাল মেমোরিকে যেভাবে ডিল করি অনেকটা সেভাবে। ওনার বাবার চরিত্রে অথবা উনার গ্রান্ডফাদারের চরিত্রগুলো উনি যেভাবে ডিল করেছেন, মেমোরিকে যেভাবে রি-কন্সট্রাক্ট করেছেন এটা খুব অসাধারণ লেগেছে আমার কাছে। সিনেমার ভাষার দিক থেকে আমরা যে ধরনের চলচ্চিত্রের ভাষার প্রাকটিস দেখি বাংলাদেশে এবং ভারতে এর থেকে এক্কেবারে সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের একটা চেষ্টা এবং ছবিটা দুর্বোধ্য না এবং পুরো ছবি অলমোস্ট হ্যান্ডহ্যাল্ড এ করা কিন্তু কোথাও মনে হয় না ছবিটা ডির্স্টাব করে।
আমি ছবিটা দেখছিলাম জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে, গতবার ঢাকায় হওয়া একটা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ছবিটা দেখানো হয়েছে। ছবিটা দেখার পর থেকে আমি মুগ্ধ হয়ে আছি এখনো এবং এর কয়েকদিন পরেই আমি ওই ছবিটারই মত ভাষার একই ধরনের একটা ছবি দেখলাম হয়ত ওই একই মাপের নয় তবে ভাষার প্রয়োগে মিল পাওয়া যায়। আমাদের এখানে ‘হাসিনা- অ্যা ডটার্স টেল’ যেটা হয়েছে ডকুমেন্টারি, এর ভিতরেও যে চলচ্চিত্রিক ভাষায় মেমোরিকে কন্সট্রাক্ট ও রিকন্সট্রাক্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে সেটা খুবই ইন্টারেস্টিং।
সিনেমা আমার কাছে টাইম এন্ড স্পেসের সৃজনশীল উপস্থাপন। আমরা সময়টাকে কিভাবে ডিল করবো চলচ্চিত্রের কোনো ফ্রেমের কম্পোজিশনের মধ্যে, আলো, এক্টিং, সেট সবকিছুর মধ্যে আমরা টাইমটাকে কিভাবে দেখবো বা ধরবো সেটার উপর ভাষা অনেকখানি দাঁড়ায়, এসবের মধ্যে ভাষা অনেকখানি নির্ভর করে। আমি কনটেম্পোরারি সিনেমাকে দেখতে চাই অনেক বেশি পার্সোনাল সিনেমা হিসেবে এবং সিনেমারভাষা বিষয়ে যে সব ভাবনা আমার মনের মধ্যে দানা বেঁধেছিলো সেটাই যেন অনেকটা ভাষা পেয়েছে যখন আমি ‘লর্ড অফ দ্যা অরফেন্স’ দেখি। ছবিটা আমাকে সত্যিকার অর্থেই মুগ্ধ করেছে।
প্রশ্ন: শিল্প হিসেবে সিনেমা কি আদৌ ঋদ্ধ? যদি হয় তা কেন?
বেলায়াত হোসেন মামুন: এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার কিছু নেই। যেমন শাস্ত্রীয় সংগীতের বড় বড় ওস্তাদগণ যখন কোন একটা আয়োজনে গাইবেন অথবা বাজাবেন সেখানে কি হয়? পরিবেশনার আগে তারা যেটুকু কথা বলেন তখন কথা বলার আগে কানে হাত দিয়ে তাদের গুরুজিদের নাম নেন। এটা আদব। সেভাবে যদি দেখি, তাহলে আপনার এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার কিছু নেই কারণ পৃথিবীতে চলচ্চিত্রের বয়স এখন ১২৫ বছর, এবং এই ১২৫ বছরে চলচ্চিত্র যে জায়গায় পৌঁছেছে, যে সম্মান ও মর্যাদার অধিষ্ঠিত হয়েছে তাতে করে আজকের দুনিয়ায় এই প্রশ্ন অহেতুক। তবে এটা অনেকখানি সত্যি যে বাংলাদেশ চলচ্চিত্রশিল্পের বোঝাপড়ায় অনেক পিছিয়ে পড়া দেশ, কোন সন্দেহ নাই তাতে। পৃথিবীতে বহু আগেই চলচ্চিত্র আধুনিক মানুষের অভিব্যক্তি প্রকাশের শ্রেষ্ঠ মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। এক জীবনে হয়ত আপনি পৃথিবীর সেরা কাজ গুলো, এই ১২৫ বছরে যা হয়েছে সেগুলো দেখে শেষ করতে পারবেন না। আমি গত ২০ বছর ধরে খুব যত্নের সঙ্গে বেছে বেছে সিনেমা দেখছি, তারপরও বহু গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা অ-দেখা রয়ে যাচ্ছে। সো, শিল্প হিসেবে চলচ্চিত্র এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছে সেখানে আমরা আজ পৃথিবীর মহত্তম চলচ্চিত্র স্রষ্টাদের নাম নিতে গিয়ে আদবের সাথে নিয়ে থাকি। শিল্প হিসেবে চলচ্চিত্রের অধিষ্ঠান আমাদের কাছে এমনই গুরুত্বপূর্ণ স্থানে।
প্রশ্ন: আমরা দেখি ইউরোপীয় সিনেমা সবসময়ই একটা আর্টিস্টিক জায়গা থেকে ডিল করে। আবার হলিউড তার ওল্টোটা অর্থাৎ লাভের পাশটা বেশী দেখে। এই প্রবণতা কি তাদের জাতীয় চিন্তা চেতনার অংশ হতে পারে?
বেলায়াত হোসেন মামুন: যেহেতু চলচ্চিত্রের সাথে অর্থনীতি এবং রাজনীতি খুব প্রবলভাবে জড়িত, ফলে ইউরোপের চলচ্চিত্রে যে আর্ট বেশি উপস্থিত থাকে এটা তাদের বিকাশের পরিচায়ক। এটাকে এক ধরনের আইডেন্টিটির প্রকাশ বলা যায়। আর ইউএসএ’র বিশেষ করে ইন্ডাস্ট্রি সিস্টেম বা স্টুডিও সিস্টেম সিনেমার জনপ্রিয়তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, অর্থাৎ মানুষ যে ছবিগুলো খুব দেখে, তারা সেগুলোকে সহজভাবে নির্মাণ করার চেষ্টা করে, যেটা কে আমরা বলি, চলচ্চিত্রকে তারা সার্থকভাবে ‘পণ্য’ হিসেবে উৎপাদন করে । সেটা আসলে পুঁজির একটি চরিত্র। পুঁজির বিনিয়োগ ও মুনাফার মধ্য দিয়ে তারা সারা পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করার বাসনা রাখে, সেই বাসনা থেকেই এটা হয়।
কিন্তু ইউরোপে যেমন আর্ট সিনেমা হয়, ইউএসএ’তেও প্রচুর ’আর্ট’ সিনেমা হয়। স্বাধীন সিনেমার আন্দোলন সারা পৃথিবীতে যখন শুরু হয়নি, আমেরিকায় তখন সেটা হয়ে গিয়েছে। ওখানকার লোকজন তাদের মত করে স্বাধীন সিনেমার আন্দোলন করেছেন, লড়াই করেছেন, ছবি বানিয়েছেন, এখনও বানাচ্ছেন, তাই আমি বলব যে, ইউরোপের চেয়ে আমেরিকা অনেক বেশি সিনেমা ওরিয়েন্টেড জাতি, তাদের জাতি হিসেবে গড়ে ওঠাটা এই মাত্র ৫০০-৬০০শ বছরের ইতিহাস, কিন্তু ইউরোপের অনেক দেশের ইতিহাস হচ্ছে ২,০০০ বছরের বা তারও অধিক। যে যুগে আমেরিকা একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠছে সেই সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী আর্ট ফর্ম হিসেবে সামনে এসেছে সিনেমা, তাই তারা সিনেমায় সর্বোচ্চ রকম এক্সপেরিমেন্ট করেছে, ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করেছে এবং গ্লোবাল মার্কেটকে তারা নিয়ন্ত্রণ করছে, সিনেমার বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এটা কিন্তু তারা মেধা দিয়েই করছে, এমন না যে এখানে জোর জবরদস্তি ব্যাপার আছে। এটা তাদের একটা অর্জন বলতে পারেন, তারা যে বাকি বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করার বাসনা রাখে তাতে করে তারা প্রতিনিয়ত চমকে দেয়ার মত কাজ করার চেষ্টা করে। ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে এসব তো হয়ই। কিন্তু এর বাইরেও আমেরিকাতে ভালো ছবি হয়, ইউরোপে তুলনামূলকভাবে বেশি ভালো চলচ্চিত্র হয়, আমেরিকায় হয়ত একটু কম হয় কারণ আমেরিকা যে সময়ে রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠেছে সেই সময়ে আর্ট কে সমাজের ভিতরে গভীরভাবে নেয়ার আদর্শ কাঠামো যেটা ফ্রান্সের আছে বা ছিল বা ইউরোপের বহু দেশের আছে, এ দেশে মানুষের এবং সমাজের ভিতরে আর্ট এর গ্রহণযোগ্যতা বা মর্যাদা আছে, সেটা আমেরিকায় অতটা নেই, ফলে তারা ব্যবসার দিকটাকেই বড় করে দেখে। কিন্তু আমেরিকার সিনেমা যে সারা পৃথিবীর ওপরে ছড়ি ঘোরায় এটা শুধু তাদের পলিসি না,বরং এটা তাদের নৈপুণ্য। তাদের ছবি সারা পৃথিবীর মানুষের বিনোদনের একটা বড় অংশকে পূরণ করে এবং তাদের ছবিতে প্রযুক্তির অত্যাধুনিক ব্যবহার সবসময় চমকে দেয়ার মত হয়। এছাড়া তাদের যে কোনো চলচ্চিত্রে কারিগরি ত্রুটি প্রায় থাকে না বললেই চলে। এগুলো কিন্তু তাদের অ্যাচিভ করতে হয়েছে, তাই মোটা দাগে লাইন টানার দরকার নেই যে ইউরোপে বেশি ভালো চলচ্চিত্র হয় আর আমেরিকায় কম হয়।
আমার মতে, এ সব কিছুই ওই অঞ্চলের মানুষের ওই জনগোষ্ঠীর প্রবণতার অংশ। যেমন, আমাদের সিলেটের হাওড় এলাকার মানুষ গান গাইতে পছন্দ করেন, গান বানাতে পছন্দ করেন, সুরে কথা বলেন; কিন্তু আমাদের থেকে একটু দূরে যান, একটু শীতপ্রধান দেশ, ভূটানে যাবেন, সেখানকার লোকজন আমাদের মত ঠিক অতটা সুরেলা নন, এতে তাদের স্থানীয় প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের একটা ব্যাপার আছে, প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে মানুষ কিছু গ্রহণ করে, এর মধ্য দিয়ে তার ধরণ গড়ে ওঠে। ইউরোপকে দেখতে হবে তার প্রায় ২,০০০/৩,০০০ বছরের ইতিহাস হিসেবে, সেখানে আমেরিকাকে দেখতে হবে সর্বোচ্চ ৫০০ বছরের একটা অংশ হিসেবে এবং তারা ওখানে যে জাতিরাষ্ট্র গড়ে তুলেছে সেটাও সেখানকার স্থানীয় আদিবাসী মানুষকে হত্যা করে। ফলে তাদের ভিতরে এই যে দখল এবং আগ্রাসনের ব্যাপারটা প্রবলভাবে হাজির আছে এবং আরেকটা জিনিস হাজির আছে সেটা হল যে কোনোভাবে সারভাইভ করার জন্য সবচেয়ে উত্তম অবলম্বনটাকে তারা বেছে নেয়। তো এই যে আগ্রাসন এবং সারভাইভ করার প্রবণতা একদিক দিয়ে এটাকে সাম্রাজ্যবাদী বলা যায় কিন্তু আমি এ ব্যাপারগুলোকে ইন্ডাস্ট্রির এই রাজনীতির বাইরে আরও পার্সোনাল জায়গা থেকে দেখতে চাই।
রাষ্ট্র আর্টের পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারে কিন্তু কোনো রাষ্ট্র শিল্প বা শিল্পীর জন্ম দেয় না বা দিতে পারে না, শিল্প জন্ম দেয় শিল্পী। শিল্পীর সত্ত্বা কোনো রাষ্ট্রের কাঠামোতে বন্দি থাকে না, শিল্পীর মনের মধ্যে শিল্প জন্ম নেয়, শিল্পীর মননের মধ্যে শিল্প জন্ম নেয়। তাই কোনো রাষ্ট্র আগ্রাসী হতে পারে, সাম্রাজ্যবাদী হতে পারে। কিন্তু শিল্প আগ্রাসী কোনো অস্ত্র নয়। হতে পারে না। বরং সবরকম আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় বলেই কোনো সৃষ্টি শিল্প হয়ে ওঠে।
প্রশ্ন: আপনি নিজেও তো আজকে অনেক বছর চলচ্চিত্র সংসদ এবং চলচ্চিত্র আন্দোলনের সাথে জড়িত। এতটা সময় হাঁটতে গিয়ে কি মনে হয়নি, চলচ্চিত্রের জন্য এই উৎফুল্লতা কেবলই ব্যাক্তিকেন্দ্রীক, সমষ্টিতে তা আসলে বৃথা?
বেলায়াত হোসেন মামুন: না, তা মনে হয়নি। মানে ডেফিনেটলি চলচ্চিত্র শিল্প আন্দোলন বা ফিল্ম সোসাইটি মুভমেন্ট আমরা যেটাকে বলি, সেটা খুবই পার্সোনাল, এটা কিছু ব্যক্তি মিলে করেন, তারা সেই চর্চা জারি রাখতে চেষ্টা করেন সমাজে। চেষ্টা, কষ্ট, লড়াই সবই ব্যক্তি করেন কিন্তু তার ফলটা সমাজ ভোগ করে। আজকে বাংলাদেশে যেটুকু ভাল ছবির কথা যেটুকু ইন্টেলেকচুয়াল এক্সারসাইজ হয় তার পিছনে এই চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন এর সবচেয়ে বড় ভূমিকা আছে। তো সেটা ফিল্ম সোসাইটি এর লোকজন করেছে, করছে এবং করবে। এটা একটা রিলে রেসের মতো ব্যাপার, ম্যারাথন দৌড়, ১০০ মিটার দৌড় না। তাই শিল্প আন্দোলন কে কখনও টাইম ফ্রেমে আটকানো যায় না। মানুষ যতদিন আছে, মানুষ শিল্পের চর্চা করবে, আরও শুদ্ধতার চর্চা করবে, নিজেকে এক্সপ্রেস করার জন্য আরও সর্বোত্তম উপায় খুঁজে বের করবে, সেটা চলমান, আর শিল্পচর্চাও চলমান, আন্দোলনটাও চলমান। আর যেহেতু সিনেমা একটা কমার্শিয়াল ইন্ডাস্ট্রি, তাই এর নিম্নগামিতার বিরুদ্ধে শুদ্ধতার জন্য সবসময় লড়াই করতে হয়, লড়াইটা যদি না থাকে, তাহলে সমস্তটাই গুবলেট হয়ে যাবে। মানে, আজকে বর্তমান সরকার যদি কোনো ভুল করেন এবং ধরে নিই, ১০০ ভাগ লোক সেটার প্রতিবাদ করছে না, একজনও না, তাহলে এই সমাজ, এটা একটা ডেড সোসাইটি হয়ে যাবে, মৃত সমাজ। আগামীতে এই ভুলের মাশুল সমগ্র জাতিকে দিতে হবে এক সময়। কিন্তু যদি আজকে ১০০ জনের মধ্যে নূন্যতম ১০ জন লোক সেটা নিয়ে প্রতিবাদ করে, সেটা নিয়ে কথা বলে, সেটাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে অথবা রাজপথে, তাহলে এই প্রতিবাদ সমাজের মধ্যে একটা রেজিসটেন্স তৈরি করবে। তো ইন্ডাস্ট্রি সবসময় চায় তাদের প্রোফিটকে ম্যাক্সিমাইজ করতে এবং তার সামনে যা পড়বে, সেগুলোকে বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দিবে বা নষ্ট করবে, পুঁজির বিনিয়োগ ও মুনাফার কাঠামোটা এমনই, নৃশংস, নির্দয় এবং নোংরা।
ভাবুন এই দৃশ্যকল্পটি, একটা বুলডোজার এগিয়ে আসছে, তার বিপরীতে একজন মানুষ এক গুচ্ছ ফুল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং বলছে, তোমাদের এই বুলডোজার থামাও, একটু সামনেই একটি বড় সুন্দর গোলাপের বাগান আছে, তোমরা সেটাকে মাড়িয়ে দিও না, এটাকে নষ্ট করো না। এই যে বলছে, কিন্তু এটা তো যন্ত্র, একটা লোহার যন্ত্র, এই বুলডোজার তো শুনতে পারবে না, কিন্তু এটা যে চালায় বা পরিচালনা করছে সে শুনতে পারবে। এখন এই ঘটনার স্থানের চারপাশের বেশিরভাগ লোকই আফিমে মশগুল। এই আফিম বহুরকমের হতে পারে। দলীয় রাজনীতির, ধর্মীয় উগ্রতার অথবা মূর্খতার। যে কোনো ঘোরেই মশগুল হোক, দেখা যাবে এই সমবেত লোক বুলডোজারকে বাহবা দিচ্ছে, উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করছে, বলছে, পিশে দাও! পিশে দাও! কিন্তু তাদের মধ্যেও কোনো কোনো লোক থাকতে পারে যে বলতেই পারে যে, এটা ঠিক হচ্ছে না। এমন হতে পারে এবং হয়ও। এই যে একটি লোক। যে প্রতিবাদ করলো। সে কে? সে তো হুট করে আকাশ থেকে পড়বে না। পড়েও না। সে এই সমাজেরই লোক। তার হদিশ করলে দেখবেন সে লোকটি সংস্কৃতিবান্ধব, ঐতিহ্যপ্রিয় এবং সংস্কারমুক্ত মানুষ। সে এই সমাজেরই মধ্যে তাকে কিন্তু সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠের মত অন্ধ নয়।
তো আমার কথা হলো, থাকুক না একটু বৈচিত্র্য। আমরা হয়ত সবাই কুমীরছানা, ও থাকুক না গোলাপের চারা নিয়ে। করুক না সে ফুলের চাষ, কী ক্ষতি হয় তাতে? ও থাকুক ওর মতো। ওর এই যে শুভবোধ, এটা সমাজের গভীরতম অন্ধকারের মধ্যেও আশার আলো দেখাবে। এজন্য আন্দোলন জারি রাখতে হয়। এটা মিটিং মিছিলের আন্দোলন না, এর দাবিটা অন্তরের জায়গা থেকে আসে, মানুষের ভিতরের সুপ্ত অন্তরকে শিল্পবোধে জাগিয়ে তোলার জন্য, তার ভিতরের অধিকতর শুদ্ধ মানুষটাকে জাগিয়ে তোলার জন্য, তার ভিতরের সকল ধরণের গোঁড়ামি দূর করার জন্য, তো এমন চর্চা ও শিল্প আন্দোলন থেকে কত ধরণের ইমপ্যাক্ট হতে পারে সোসাইটিতে, সেটা আসলে আমরা কখনও চিন্তাও করতে পারি না। কারণ, কোনো একজন ফিল্ম অ্যাক্টিভিস্ট সে হয়তো পুলিশে চাকরী করে, কোনো ফিল্ম অ্যাক্টিভিস্ট সে হয়তো কবি, কোনো ফিল্ম অ্যাক্টিভিস্ট সে হয়তো মুদি দোকান চালায়; যদিও এখন মুদি দোকান উঠে যাচ্ছে, সব ডিপার্টমেন্টাল স্টোর হয়ে যাচ্ছে; তো সে হয়তো ফিল্ম সোসাইটি অ্যাক্টিভিস্ট বলে মানুষজনের সাথে একটু ভদ্রভাবে কথা বলে, অন্যদের মতো চিৎকার করে না, অন্যদের মতো অসভ্য আচরণ করে না। এই যে একটুখানি তার ভিতরে মনুষ্যত্বটাকে জাগিয়ে তোলা- এটাই শিল্পের কাজ। শিল্পের রাজনীতি অনেক গভীর ও ধীর, শিল্পের মাধুর্য মানুষের মনে লেগে থাকে আমৃত্যু। এর বাইরে বাকি সমস্তকিছু মুখরোচক, খাবেন, একটুপর ভুলে যাবেন, মনে থাকবে না কি খেয়েছিলেন। শিল্প মহত্তম ব্যাপার, কারণ শিল্প মানেই হল মানুষের মহত্তম চিন্তা, আর্ট মানেই মানুষের মহত্তম চিন্তা। আর মহত্তম তাই হয় যা সত্য ও সুন্দর, কল্যাণকর। যেটা মহত্তম, যেটা সুন্দর, যেটা কল্যাণকর, তার ইমপ্যাক্ট সোসাইটিতে গভীরভাবে, প্রবলভাবে দেখা যায়।
প্রশ্ন: আপনার কি মনে হয়, স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের হাত ধরে খুব শীগ্রই বাংলা সিনেমার সংকট কাটতে যাচ্ছে?
বেলায়াত হোসেন মামুন: বাংলাদেশে স্বাধীন মানুষ খুব বিরল। যেখানে মানুষের স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ সেখানে ‘স্বাধীন চলচ্চিত্র’ কোত্থেকে আসবে? যে মানুষ স্বাধীন নয় সে মানুষ স্বাধীন চলচ্চিত্র করতে পারবে না। পারার কথা নয়। তাই স্বাধীন চলচ্চিত্রের যে প্রচলিত ধারণা আমাদের চলচ্চিত্র অঙ্গনের মানুষের মাথায় আছে সেটা একেবারে গোঁজামিলে ঠাসা। এটা আত্মপ্রবঞ্চনার মত একটা ব্যাপার ঘটছে। দেখা যাচ্ছে সে নিচ্ছে কোনো কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের স্পন্সর কিন্তু বলছে সে ‘স্বাধীন চলচ্চিত্র’ নির্মাণ করছে! এটা হাস্যকর ব্যাপার। যারা সরকারি অনুদানে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন বা করেছেন তারা কিভাবে দাবি করেন তাদের ওইসব অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘স্বাধীন’? এসব স্বাধীন চলচ্চিত্রই না। স্বাধীন শব্দটার অর্থই এরা ভুলভাবে ব্যাখ্যা করছে। কথা হলো এই ভুল ব্যাখ্যা কি সে অপর মানুষের সাথে কেবল করছে নাকি সে নিজেও এই ভুলের ফাঁদে আটকে আছে?
কোনো সৃষ্টিকে যদি স্বাধীন হতে হয় তাহলে সে সৃষ্টির সৃষ্টিকর্তাকে প্রথমে স্বাধীনতার চর্চা করতে হবে। তাকে প্রচলিতে ফাঁদে না পড়ে এক্সেপশনাল হতে হবে। সমাজের, রাষ্ট্রের বা কোনো সংস্কারের দাসত্ব না করে তাকে সব রকম ভয়-ভীতি থেকে মুক্ত হতে হবে। তারপরেই না সে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারবে, সৃষ্টি করতে পারবে। ‘স্বাধীন চলচ্চিত্র আন্দোলনের ইশতেহার’ নামে আমি যে গ্রন্থটি লিখেছি, সেখানে স্বাধীন চলচ্চিত্র, স্বাধীন চলচ্চিত্রকার এবং স্বাধীন চলচ্চিত্র আন্দোলন বিষয়ে আমি বিস্তৃতভাবে আমার চিন্তা ও বিশ্লেষণ হাজির করেছি। সে দৃষ্টিতে যদি দেখি তাহলে আমার প্রশ্ন, বাংলাদেশে স্বাধীন চলচ্চিত্র কোথায়?
প্রশ্ন: সমকালীন সময়ে বাংলাদেশে কোন নির্মাতার নির্মাণ আপনার ভালো লাগে? তা কেনো?
বেলায়াত হোসেন মামুন: সম্প্রতি আব্দুলাহ্ মুহম্মদ সাদ নির্মিত ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’ দেখেছি। আমি ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’ দেখে অনেকখানি মুগ্ধ হয়েছি, আমার খুব ভালো লেগেছে ছবিটা। এবং আমার ভালো লেগেছে ‘হাসিনা- অ্যা ডটার’স টেল’ আর এর বাইরে সম্প্রতি মুগ্ধ হওয়ার মতো কোনো দেশীয় ছবি আমি দেখি নি।
প্রশ্ন: এখনতো বিভিন্ন ফেস্টিভ্যাল থেকে নির্মাতারা চাইলে ফান্ডিং পেতে পারে যদি তার গল্প মানসম্পন্ন হয়, এই সুযোগ কি একজন নির্মাতার নির্মানের সঠিক চর্চা হতে পারে?
বেলায়াত হোসেন মামুন: বিভিন্ন ফেস্টিভ্যালে চাইলেই কেউ ফান্ড পাবে বিষয়টা তো এমন নয়। মানসম্মত গল্প হলেও পাবে এটারও কোন নিশ্চয়তা নেই কারণ যে টাকা দেয় সে তার পলিসি বা রাজনীতি অনুসরণ করেই টাকা দেয়, আর যে টাকা নেয় সে টাকাদাতার শর্ত মেনেই টাকা নেয়। বিষয়টা তখন এমন হয় যে, বেশ- আমি আপনার শর্ত মেনে নিচ্ছি, আপনার চাওয়ার মত করেই আমি কাজটা করবো। টাকা কেউ এভাবে দেয় না যে আপনি আপনার মতো করে কাজ করবেন। এটা একমাত্র পিতামাতাই করতে পারেন, এতটা নিঃস্বার্থভাবে ভাইবোনরাও আজকাল টাকা দেয় না। যে, নে টাকা, তুই তোর মতো সিনেমা বানা। এটা বাবা-মা করেন কারণ তারা নিঃস্বার্থভাবে সন্তানকে ভালোবাসেন।
এখন কথা হলো, যে কোনো ফান্ড তা বিদেশি হোক আর দেশের, ফান্ড কখনো শর্তের বাইরে হয়না। তো মানসম্পন্ন চলচ্চিত্র মানে অর্থায়নকারীর ইচ্ছার যে মান সে অর্থে মানসম্পন্ন হতে হবে তাহলেই সে টাকা দিবে। অপরের ইচ্ছার অনুসারে গল্প বা চিত্রনাট্য লিখে ফান্ড পাওয়া এটা কোনো স্বাধীন চলচ্চিত্রকারের চাওয়া হতে পারে না।আমার মতে, এটা একধরনের আত্মসমর্পণ। এই আত্মসমর্পণ করে খুশি হওয়াও যায়, খুশি না হওয়াও যায়। এটা ব্যক্তির নিজের সিদ্ধান্তের বিষয়। আমি ‘স্বাধীন চলচ্চিত্র আন্দোলন’কে বিশ্বাস করি। তাই যে কোনো ধরনের সমর্পণকে আমি অপছন্দ করি। এটা আমার মত।
প্রশ্ন: দেশে যে গুটিকয়েক ভালো সিনেমা হয় সেটাও ফেস্টিভ্যাল কেন্দ্রীক, সাধারণ মানুষ তা আদৌ পুরোপুরি নেয় না। কিন্তু প্রশ্নসাপেক্ষে আমরা দেখি যে, তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ যেমন সাধারণ মানুষও নিয়েছে আবার ‘কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও’ সারা পেয়েছে। তাহলে এই সংকটটা কোথায়? আমাদের নির্মাতারা কি পরিপক্ব নন? নাকি আমাদের দর্শক পরিপক্ব গল্পের জন্য এখনও প্রস্তুত না?
বেলায়াত হোসেন মামুন: ছোট করে যদি প্রশ্নটা বলি, তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ দর্শক এবং উৎসব দুই জায়গাতেই প্রশংসিত হয়েছে কিন্তু অন্যদেরটা হচ্ছে না কেন? এই তো, নাকি? কথা হলো, প্রশ্নের ভিতরে কোথাও একটা ইঙ্গিত আছে যে, চলচ্চিত্রকে দর্শকপ্রিয় হতে হবে। আপনার প্রশ্নের মধ্যে এইরকম একটা অভিপ্রায় আছে।
এখানে আমার প্রশ্ন- আমরা চলচ্চিত্র কার জন্য নির্মাণ করি? মানুষের জন্য? কিন্ত সব মানুষ তো আমার চলচ্চিত্রের দর্শক নাও হতে পারে। আমি অস্বীকার করছি না যে প্রত্যেক চলচ্চিত্রনির্মাতা চান কিংবা প্রত্যেক চলচ্চিত্রকর্মী চান তাদের সিনেমা সব মানুষ দেখুক, এটা দোষের কিছু না কিন্তু সমস্যাটা হলো যে, চলচ্চিত্রের নির্মাণ থেকে প্রদর্শন পর্যন্ত প্রক্রিয়াটা একজন ব্যক্তি নিয়ন্ত্রণ করে না, একটা গ্রুপ অব পিপল এই প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত থাকে। সো, এই প্রক্রিয়ার ভিতরে যখন স্ক্রিপ্টিং হয়ে যায় তারপর থেকে এটার সাথে প্রচুর লোক যুক্ত হতে থাকে, তার মধ্যে ম্যানেজমেন্ট একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হয়ে ওঠে তখন এবং একশো রকমের লোককে একত্র করে একটা সৃষ্টিশীল কাজ করা ভয়ঙ্কর কঠিন একটা ব্যাপার। এটা একটা নিজে নিজে ছবি আঁকা নয়, সিনেমা বানানো তার চেয়ে হাজারগুণ কঠিন কাজ। হয়ত এসব কারণে সিনেমা সবচেয়ে শক্তিশালি মিডিয়ামও। তো যাই হোক, এতো কষ্ট করে একটা কাজ করে সবার সাথে শেয়ার না করতে পারা কোনো কাজের কথা নয়। কিন্তু এটাও তো সত্য যে, সব কাজ সবার জন্য নয়, সব কাজ চলমান সময়ের জন্যেও নয়, কোন কোন কাজ হয়তো এখন বানানো হচ্ছে কিন্তু এটা সত্যিকার অর্থে দেখা হবে আজ হতে বিশ বছর পর, বিশ বছর পর হয়ত এই কাজটির সঠিক মূল্যায়ন বা বিচার হবে। হয়ত এই যুগে ওই ছবিটি বিচার করার মত হয়তো যোগ্য মানুষই নেই। হয়ত এই সময়ে ওই কাজটি একজন দুইজন দেখেছে বা পাঁচশ লোক দেখেছে কিন্তু বাকীরা দেখে নাই। তো এভাবে আসলে শিল্পের বিচার করা যায় না।
সিনেমার ডিস্ট্রিবিউশনের মেকানিজম সিন্ডিকেশনের বিষয়, এটা হাইলি পলিটিক্যাল, ইন্ডাস্ট্রি ওরিয়েন্টেড করাপশানের ভিতর দিয়ে এটা যায়। সো, ওর ভিতর দিয়ে একজন ইনডিপেনডেন্ট ফিল্মমেকার বা একজন অল্টারনেটিভ ফিল্মমেকার অথবা জাস্ট ইন্ডাস্ট্রির কোনো সাধারণ নির্মাতা, এটা ওই নির্মাতার নিজস্ব দক্ষতার প্রশ্ন যে সে তার সিনেমাটা এই জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে কিভাবে রান করাতে পারবে। অধিক সিনেমাহলে যে সিনেমার প্রচার হয় না সে সিনেমার কথা তো মানুষ জানতেই পারে না। তারমানে মানুষকে জানানোটাও একটা বড় প্রতিবন্ধকতা। এখন যে সব গণমাধ্যম আছে সে সব গণমাধ্যম কোনো না কোনোভাবে ব্যাক্তি মালিকানাধীন। ওই ব্যক্তির প্রতিষ্ঠান যদি না চায়, যদি প্রথম আলো না চায় যে, আপনার নাম প্রথম আলো ছাপবে না, আপনি কিভাবে মানুষের কাছে পৌঁছুবেন? আপনি হয়তো অনলাইন দিয়ে পৌঁছুবেন বা আরও অন্য অন্য পথে চেষ্টা করবেন কিন্তু এই চেষ্টাগুলোর তো একটা লিমিটেশন তৈরি হয়ে গেলো। কারণ প্রথম আলো তো সবচেয়ে প্রচারিত দৈনিক এবং তার একটা প্রভাব আছে সমাজে। এর অর্থ হলো, যার সাথে প্রথম আলো’র লিঁয়াজো বেটার হবে সে অন্য নির্মাতার চেয়ে একটু বেশি প্রচার পাবে। সুযোগটাও তার বেশি হবে। তারমানে পুঁজিবাদী এই স্ট্রাকচারের যুগে কোনো মানুষ, কোনো কাজ সবার কাছে পৌঁছুতে পারছে এটা অনেক স্ট্রাগলের প্রশ্ন।
আর যদি এই স্ট্রাকচার বা সিস্টেমকে সন্তুষ্ট করে বেশি প্রচার ও সুযোগ পেতে চান তাহলে এই সময়ের সিনেমার ওমুক ব্যবসায়ী ভাই, তমুক ব্যবসায়ী বড়ভাইয়ের পছন্দের মতো করে পেঁয়াজটা কাটতে হবে বা সিনেমাটা বানাতে হবে। এর বাইরে অন্য পথগুলো একটু নয়- অনেক কঠিন।
এবার আসি তারেক মাসুদ কিভাবে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছেছেন! আসলে তারেক মাসুদ এই সিস্টেমটার ভেতরেও ছিলেন এবং বাইরেও ছিলেন। তিনি নিজের জন্য এক ভিন্নতর পথ তৈরি করে নিয়েছিলেন। সে পথে একা একা ফাইট করেছেন। তিনি ভাবতেন ছবি বানানোতেই তার কাজ শেষ হয় না, ছবিটা দর্শকের ঘরে বা দর্শকের সামনে নিয়ে যাওয়াটাও তার কাজ। সে সময়ে বাংলাদেশে তারেক মাসুদের মতো প্রতিষ্ঠিত নির্মাতা দ্বিতীয়টি ছিলেন না। তো, তারেক মাসুদের ছবি পৃথিবীর বিভিন্ন ফেস্টিভ্যালে দেখানো হয়েছে এটা তার আর্টিস্টিক দক্ষতা আর বাংলাদেশে তারেক মাসুদের সিনেমা সবাই দেখেছে এটা তার সাংগঠনিক দক্ষতা ও শ্রমের প্রমাণ। তিনি ব্যক্তিগতভাবে শুধু সিনেমাটাই করতে চেয়েছেন। সিনেমাই করেছেন। দেশের চলচ্চিত্র-সংস্কৃতিতে এমন কিছু নেই যা তিনি করেন নি। বাকী অধিকাংশ নির্মাতা তো আলু পটলের ব্যবসার পাশাপাশি সিনেমা করেন, হয়ত এটা তাদের জীবন ও জীবিকার বাস্তবতা। হয়ত দেশের চলচ্চিত্র তাদের জীবিকার সুরক্ষা দিতে পারছে না। এ সবই সত্য। তবুও আমি বলবো, সিনেমার প্রতি প্রেম থেকে যদি সবাই সিনেমা করতেন তাহলে কবেই তো এই দেশের সিনেমা ভালো হয়ে যেতো।
প্রশ্ন: একজন ‘নৈরাজ্যকারী’র প্রশ্ন, যদি আপনাকে জিজ্ঞেস করি, ‘সত্যজিত, মৃণাল, ঋত্বিক’ এই ত্রয়ীর কাজ আজ সিনেমাচর্চার ক্ষেত্রে সেকেলে; আপনি কি যুক্তি দিয়ে এই দোষকে খণ্ডন করতে আগ্রহী?
বেলায়াত হোসেন মামুন: ঋত্বিক কুমার ঘটক এই তিনজনের মধ্যে একটু আলাদা। এই তিনজনের মাঝে তাকে ওইভাবে বিচার করার কিছু নেই, কারণ তিনি সর্বোচ্চ আধুনিক এবং অনাধুনিক সিনেমা বানিয়েছেন। অনাধুনিক এই অর্থে যে, উনি একেবারে মেলোড্রামাটিক ছবি বানিয়েছেন কিন্তু সে মেলোড্রামার ভিতরেও মহত্তম এমন কিছু ঘটনা উনি ঘটিয়েছেন যেগুলো শেষ পর্যন্ত আর মেলোড্রামার মধ্যে থাকে নি। ওনার জীবন ও সৃষ্টি অদ্ভুত এবং অপ্রথাগত। উনি একাধানে ভীষণ সত্য এবং মর্মান্তিক হয়ে ওঠেন। ঋত্বিক ঘটককে আমরা এজন্য একটু পাশে রেখ অপর দুই কীর্তিমানের বিষয়ে কথা বলি।
মৃণাল সেন যে সময়ে ‘খারিজ’ বানাচ্ছেন, মৃণাল যে সময় ‘একদিন প্রতিদিন’ বানাচ্ছেন, ‘একদিন প্রতিদিন’ বা ‘খারিজ’ এর গল্প বলার যে সিনেমেটিক ভাষা, স্থিরতা, জীবনের যে খুব সাধারণ ছোট্ট পলকা কোনো ঘটনা, সে ঘটনাকে বলতে গিয়ে সমকাল, জীবন, রাজনীতি অথবা পুরো রাষ্ট্র কাঠামোরও একটা গভীর সত্য তুলে নিয়ে আসা সেটা তো বিস্ময়কর ব্যাপার। মৃণাল সেন তখন যা করেছেন তা আজকে ইরানের আসগর ফরহাদী করছেন। সিনেমার ওই ভাষা ইনভেন্টেড বাই মৃণাল সেন যেটা আসগর ফরহাদী আজ প্রাকটিস করেন। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক একটি ছবি যেমন ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’ এই ছবি কোথাও কোথাও ভাষার জায়গা থেকে মৃণাল সেনের ‘ইন্টারভিউ’ ছবিটা দেখলে কেমন যেন একটা ধাক্কা লাগে, মনে হয় ‘ইন্টারভিউ’ দ্বারা কোথাও কোথাও অনুপ্রাণিত এই ছবি। মানে জীবন থেকে ছিটকে পড়া, সমাজে স্ট্রাগল করতে থাকা, সময়ের সাথে খাপ খাওয়াতে না পারা মানুষের গল্প। একই ধরনের ন্যারেটিভ স্টাইল, শুধু ক্যামেরা বদলেছে, প্রযুক্তি বদলেছে, ঘটনার লোকেশন ও ঘটনার বিষয়বস্তু বদলেছে। এ ক্ষেত্রে আমি বরং বলবো মৃণাল সেন তার ‘ইন্টারভিউ’তে যতো পারফেকশন অর্জন করেছিলেন সাম্প্রতিক ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’ অতখানি অর্জন করতে পারেনি। মৃণাল সেন ‘খারিজ’-এ সমস্যার মানবিক টানাপোড়েনের যত গভীরে যেতে পেরেছিলেন, আমার মনে হয়, আসগর ফরহাদী ঠিক ততো গভীরে যেতে পারছেন না, কিন্তু তিনিও তার মত করেই দূর্দান্ত কাজ করছেন। তাহলে মৃণাল সেন সেকেলে কিভাবে হলো? অসম্ভব!
আমার বক্তব্য হলো, মৃণাল সেনকে আমাদের আরও ভালো করে পড়া জরুরি, এই পড়া ও চর্চার মধ্য দিয়ে আমরা বর্তমান বাস্তবতাকে কিভাবে ডিল করবো তা আরও ভালোভাবে বুঝতে পারবো। ঋত্বিক বা মৃণালের মত মাস্টার চলচ্চিত্রকারগণ কখনও সেকেলে হয় না। বরং আমরা তাদের মানের কাছাকাছি পৌছুতে পারি না বলে কখনো কখনো ব্যক্তিগত অক্ষমতায় এ সব বলে থাকি। এ যদি না হয় তবে তো সেকেলে বলতে হবে টলস্টয়কে, সেকেলে বলতে হবে শেক্সপিয়ারকে, সেকেলে রবীন্দ্রনাথও। আমরা তো বলি না, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস পড়লেই হবে রবীন্দ্রনাথ পড়ার দরকার নাই, এটা বলা যেমন মূর্খতা, তেমনি ঋত্বিক, মৃণাল, সত্যজিতকে সেকেলে বলার দৃষ্টতাও একরকম মূর্খতা।
প্রশ্ন: সত্যজিত সম্পর্কে আপনি কি বলেন?
বেলায়াত হোসেন মামুন: সত্যজিত সর্ব অর্থেই একজন মহান সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্ব। তার সৃষ্টির ব্যাপ্তি ও বৈচিত্র বিস্ময়কর। পাশাপাশি তিনি একজন পুরোদস্তুর পারফেকশনিস্ট। আর সব কিছু বাদ দিয়ে শুধু যদি তার ‘পথের পাঁচালী’ নিয়ে কথা বলি তবে সে আলাপ সহজে শেষ হবে না।
‘পথের পাঁচালী’তে যে কাজ ওনি করেছেন ওইমানের সৃষ্টিশীলতা অতুলনীয় এবং আজও তা অন্য কারো পক্ষে এচিভ করা সম্ভব নয়। এখনও আমরা বিস্মিত হই, এটা শুনতে ক্লিশে লাগলেও এটা কোনো ক্লিশে কথা না। প্রত্যেকবার, এই ছবি যতবার দেখি প্রত্যেকবার নতুন লাগে। আপনার গভীর মনের দৃষ্টিতে যখন চলচ্চিত্র অনুধাবন করতে প্রশিক্ষিত হবেন, যখন আস্তে আস্তে ছবি দেখার চোখ ও মনন আপনার তৈরি হবে, যখন ‘পথের পাঁচালী’ আপনি বহুবার দেখতে থাকবেন, তখন আপনি অবাক হয়ে আবিষ্কার করবেন যে এই ছবিটা দেখাটা আপনি প্রতিবার নতুন করে দেখছেন। আপনার দেখা শেষ হবে না, কারণ ওই সময়টা, ওই সময়ের মানুষের জীবনকে আপনি প্রতিবার নতুন নতুন চিন্তায় ও দর্শনে উপলব্ধি করবেন। এটা খুব সহজ একটি ছবি। অথচ কত অসাধারণ। আর সব বাদ দিন। ওই ১৯৫২/৫৫ সালের আর এমন একটি ছবি পাবেন না যেখানে থিয়েটারের কোন নামগন্ধ নাই, আজকের বাংলাদেশের এমন ছবি বিরল যে ছবির অভিনয়রীতিতে থিয়েট্রিক্যাল ঢঙ উপস্থিত নেই। অথচ সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’তে কোথায় কোন সিকোয়েন্স থিয়েটার প্রভাবিত? একটা ফ্রেমও তেমন নেই যে ফ্রেমে আপনি দেখাতে পারবেন যে এটা মঞ্চের স্ট্রাকচারে ওনি ফ্রেমিং করেছেন, বা কম্পোজিশন করেছেন বা ক্যামেরা এমনভাবে বসিয়েছেন যে এটা দেখলে মনে হবে থিয়েটার ধরনের পার্সপেক্টিভ, না এটা বলার সুযোগ নেই আপনার! আসলে আমরা আজও, এত পেছনে পড়ে আছি যে, আমরা আমাদেরই কীর্তিমানদের কাছাকাছিও পৌঁছতে পারছি না। অথচ অনেক সময় আমাদের অহঙ্কার এমনভাবে প্রকাশিত হয় যে, আমরা যেন কী হাতি-ঘোড়াটাই না করে ফেলেছি!
প্রশ্ন: আপনার কাছে শেষ প্রশ্ন, শিল্পমাধ্যম তো সবসময়ই পরিবর্তনশীল। সে সাপেক্ষে সিনেমাও কি একদিন গত হয়ে যাবে?
বেলায়াত হোসেন মামুন: আমি জানি না সেটা। সিনেমা গত হবে কিনা আমি জানিনা তবে আমার লাইফটাইমে এমন কিছু ঘটবে না এটা আমি নিশ্চিত। আমার জীবদ্দশায় বা আমার এখন যে বয়স এট লিস্ট আরো, যদি স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকি তাহলে আরো বিশ পঁচিশ হয়ত বাঁচবো। আর এই বিশ পঁচিশ বছর যদি বেঁচে থাকি, আমি সিনেমার মৃত্যু দেখে যাবো না, এটুকু তো বলতেই পারি।
বরং আমি আশা করছি যে বাংলাদেশে খুব শীঘ্রই একটি আইম্যাক্স থিয়েটার হবে এবং আমি বা আমরা ওখানে বসে পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিকতম টেকনোলজিতে নির্মিত অত্যাশ্চর্য সিনেমাটা খুব আরামের সঙ্গে দেখবো। ঋত্বিক বলেছিলেন, তিনি সিনেমার প্রেমে পড়েন নি। কিন্তু আমি বলছি, আমি সিনেমাকে ভালোবাসি৷ আমি সিনেমার প্রেমে পড়েছি। এবং আমি সিনেমা ছেড়ে আর কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করি না। কারণ আমি মনে করি সিনেমা এতোটা অসাধারণ মহত্তম অবস্থানে পৌঁছেছে যে আজ পুরো পৃথিবী সিনেমাময়; সেটা থিয়েটার হোক, সঙ্গীত হোক অথবা আর যা কিছু হোক- সবকিছু আজ চলচ্চিত্র হওয়ার চেষ্টা করে, সবকিছু।
ছবিসূত্র: এই সাক্ষাতকারে ব্যবহৃত ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত