একটি দেশ বা একটি ভূখণ্ডের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য মূলত গড়ে ওঠে সেখানকার অতীত ও বর্তমান আর্থ-সামাজিক পরিবেশের প্রেক্ষাপটে। আর সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত শিল্প, যেমন- চলচ্চিত্র, একটি ভূখণ্ড বা দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে সাহায্য করে। শিল্পের অন্য যে কোনো কলার সঙ্গে চলচ্চিত্রের পার্থক্য হলো, এর প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল প্রকাশমাধ্যম এবং প্রকাশভঙ্গি। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এটি দর্শকদের অনুপ্রাণিত করে, উৎসাহ দেয় এবং বিনোদনের ঊর্ধ্বে গিয়ে মানুষকে ভাবতে শেখায়। তাই জনগণের গ্রহণ করা বিভিন্ন প্রচলিত ধারণাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য শাসক ও সরকারের কাছে চলচ্চিত্র বা সিনেমা একটি মূল্যবান মাধ্যম। আমরা যদি গোটা বিশ্বের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাবো যে দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশ, যেমন ভারত, বাংলাদেশ, ইরান, চীন, মালয়েশিয়া, এরকম কিছু দেশ বাদে আর কোনো দেশেই চলচ্চিত্রের জন্য সেন্সরবোর্ড নেই। বাকি দেশগুলোতে সেন্সরশিপ শুধু শিশু পর্নোগ্রাফির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এছাড়া আর কোনো কিছু তারা সেন্সর করে না, শুধু দেখার আগে ‘প্রিভিউ গ্রেড’ দিয়ে প্রত্যায়িত করে থাকে।
আমি আগেই বলেছি, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য যেমন বর্তমানের প্রয়োজন হয়, তেমনই এর ভিত আসে অতীত থেকে। এখন আমরা যদি বাংলাদেশের অতীতের দিকে তাকাই, তাহলে আমরা বুঝতে পারবো যে, উপনিবেশিক আমলে ভারতীয় উপমহাদেশে চলচ্চিত্রের আবির্ভাব ঘটে যখন ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের গতি বাড়ছিলো সে সময়টিতে। তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতীয় সরকার “আপত্তিকর চলচ্চিত্রের প্রদর্শন রোধ করতে” তখন সিনেমাটোগ্রাফ অ্যাক্ট, ১৯১৮ গঠন করে। পরবর্তীতে দেশভাগের পর ১৯৫২ সালে এটি ইস্ট বেঙ্গল বোর্ড অব ফিল্ম সেন্সর তৈরীর ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিলো, যা কি না জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’র মতো চলচ্চিত্রও নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়েছিলো। যদিও পরবর্তীতে ‘জীবন থেকে নেয়া’ মুক্তি পায়। ব্রিটিশ-ভারতীয় সেন্সর বোর্ড দ্বারা প্রথম আপত্তিকর চলচ্চিত্র বলা হয় ১৯২১ সালের ‘ভক্ত ভিদুর’ সিনেমাকে। ভারতীয় সিনেমাটোগ্রাফ কমিটি উদ্ধৃত করে যে, “এটি (চলচ্চিত্রটি) সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তৃষ্টি এবং জনগণকে অসহযোগী হতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।”
(চলচ্চিত্র, চেতনা এবং সেন্সরশিপ, 2020)।
আমরা ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্তি পেলেও, অনেক ব্রিটিশ আইন থেকে আজও মুক্ত হতে পারিনি। আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয়ী হয়েছি, কিন্ত পাকিস্তানি আমলাতন্ত্রকে বাতিল করিনি; বরং তা নিজেদের মধ্যে আত্তীকরণ করে নিয়েছি। আর এর ফলে স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা নিজেরাই এমন সব আইন তৈরি করেছি, যা আমাদের নিজেদের হাত-পা ও মুখ বেঁধে ফেলেছে। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাক যুদ্ধ চলাকালীন আইয়ুব খান ‘সেন্সরশিপ অব ফিল্মস অ্যাক্ট’, ১৯৬৩ ব্যবহার করে ভারতীয় হিন্দি-ভাষা এবং ভারতীয় বাংলা-ভাষার চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ করে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিলো পাকিস্তানের স্থানীয় চলচ্চিত্র শিল্প রক্ষা করা। পরবর্তীতে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে, ১৯৬৩ সালের ওই আইনের ধারা ব্যবহার করে হিন্দি এবং উর্দু ভাষাভাষী চলচ্চিত্রের প্রভাব রোধ করতে ভারতীয় এবং পাকিস্তানি চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ করা হয়। আপাত দৃষ্টিতে স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষিত করার জন্য এই পদক্ষেপগুলির প্রয়োজনীয় মনে হলেও, একটি বাংলা-ভাষা কেন্দ্রিক জাতীয় চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রক্রিয়া মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে দেশের অ-বাঙালি ভাষীদের, যেমন- আদিবাসী সম্প্রদায়কে, অদৃশ্য করে রেখেছে। সেন্সর বোর্ড কিভাবে আদিবাসী সংস্কৃতি প্রান্তিককরণ করে তা স্পষ্টভাবে টের পাওয়া যায় ২০১৫ সালে। বেঙ্গল ক্রিয়েশনের নির্বাহী নির্মাতা অং রাখাইন -এর পরিচালিত দেশের প্রথম চাকমা ভাষার ছায়াছবি ‘মর থেঙ্গারি’ (আমার বাইসাইকেল) -এর প্রত্যয়ন প্রত্যাখ্যান করে বাংলাদেশ সেন্সর বোর্ড।
পরিচালক অং বিশ্বাস করেন, “আপাত দৃষ্টিতে ভাষা অবশ্যই একটি কারণ হতে পারে না। বাংলা ভাষাভাষী দর্শক কেনো আমার সিনেমার দৃশ্যায়িত ভাষা বুঝতে অক্ষম হবে এটা আমার ঠিক বোধগম্য হয়না”। চলচিত্র নির্মাতা ও সেন্সর বোর্ডের সদস্য, নাসিরুদ্দিন দিলু একমত পোষণ করেন, “যদি আদিবাসী- ভাষার সিনেমা জমা দেয়া হয়, আমরা অবশ্যই তা পর্যালোচনা করবো ”। মর থেঙ্গারি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে, দিলু বলেন, “আমি এমন কোনো সিনেমা সম্পর্কে জ্ঞাত নই। সেন্সর বোর্ডে এখন অবধি কোনো আদিবাসী-ভাষার সিনেমা জমা দেয়া হয়নি”। মর থেঙ্গারি চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে সেট করা হয়েছে এবং চাকমা ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতিকে খুব কাছ থেকে দেখানো হয়েছে। অং বলেন, তাকে “সেন্সর বোর্ড কর্তৃক বিজ্ঞপ্তি জানানো হয় যে তারা তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে একটি দীর্ঘ চিঠি পেয়েছে যাতে সিনেমাটির বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে ইস্যু তোলা হয়েছে।” এরপর তাকে অনুরোধ করা হয় সিনেমাটির অন্তত দশটি দৃশ্য কেটে ফেলার জন্য, যার ফলে তিনি সেন্সরবোর্ড থেকে ছবিটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন। আরেকটি উদাহরণ, যেখানে রাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জড়িয়েছিলো, তা হচ্ছে- ২০০৫ সালে তানভীর মোকাম্মেলের ডকুমেন্টারি ‘কর্ণফুলীর কান্না’। সেখানেও পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী সম্প্রদায়কে চিত্রিত করা হয়েছিলো। মোকাম্মেল জানান, ‘যখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক অভিযানে নিয়োজিত ছিলো, তখনকার কথা।’ পার্বত্য জনগণের প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব প্রকাশের জন্য ছবিটি নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো? উভয় ক্ষেত্রেই, ১৯৬৩ সালের আইনের যে সকল ধারা স্থানীয় চলচ্চিত্র শিল্পকে সমর্থন যোগানোর কথা বলেছিল, সেগুলোকেই ব্যবহার করা হয়েছে শিল্পের মধ্যকার বৈচিত্র্য রোধ করতে, বিশেষত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হতে উঠে আসা গল্প-কাহিনীকে নিরুৎসাহিত করতে। (চলচ্চিত্র, চেতনা এবং সেন্সরশিপ, 2020)।
বিগত এক দশকে সমগ্র বিশ্বের চলচ্চিত্র জগতের সর্বশেষ এবং এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হলো বিভিন্ন ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। যার মূল লক্ষ্য দর্শকদের সিনেমার অভিজ্ঞতা একদম হাতের কাছে এনে দেওয়া এবং সিনেমা সবার জন্য উন্মুক্ত করা। করোনা মহামারীর এই সময়ে আমরা স্বচক্ষে অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছি এবং এসব ওটিটি প্ল্যাটফর্মের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছি। কিন্তু একই সঙ্গে আমরা দেখছি এসব প্ল্যাটফর্মে প্রচারিত সিনেমা-ওয়েব সিরিজ, বিশেষ করে বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রিত ওটিটি প্ল্যাটফর্মে প্রচারিত সিনেমা-ওয়েব সিরিজের ওপর সেন্সর বোর্ডের খড়গ। বিগত দুই বছরে অন্তত ৩টি ওয়েব সিরিজ ও সিনেমা এই সেন্সর বোর্ডের খড়গে পড়েছে এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। এসব সিনেমা ও ওয়েব সিরিজের মধ্যে, সিনেমা নবাব এলএলবি (২০২০) ও নির্মাতা সাজ্জাদ খান নির্মিত ‘সাহস’ সেন্সরবোর্ডের প্রত্যাখ্যানের মুখে পড়েছে। যদিও পরবর্তীতে নবাব এলএলবি মুক্তি পায়। এছাড়াও পরবর্তীতে বাংলাদেশ ভিত্তিক ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ‘বিনজে’ শিহাব শাহীনের ‘১৪ অগাস্ট’, ওয়াহিদ তারেকের ‘বুমেরাং’ ও সুমন আনোয়ারের ‘সদরঘাটের টাইগার’ প্রচারিত হলে দর্শকদের কাছ থেকে দ্বিমুখী প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হন এর নির্মাতারা। পরবর্তীতে অশ্লীলতার অভিযোগ এনে বুমেরাং ও সদরঘাটের টাইগারকে সরিয়েও নেওয়া হয় (বিতর্কের মুখে সরিয়ে নেয়া হলো রগরগে ওয়েব সিরিজ ‘বুমেরাং’ ও ‘সদরঘাটের টাইগার,’ 2020)। এসব ওয়েবসিরিজ নিয়ে তর্ক উঠাটা সমস্যার নয়, একটি সুস্থ সমাজে সবসময়ই বিতর্ক থাকবে, একটি সুস্থ জাতি সবসময়ই বাহাসে আগ্রহী হবে। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে যখন এসব কন্টেন্টের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মোরাল পুলিশিং শুরু হয়। একজনের কাছে যেটা অশ্লীল তা অন্যজনের কাছে অশ্লীল না-ও হতে পারে। একইভাবে ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো একটি এতো বিশাল জায়গা ও সুযোগ দেয় যে, কোনো কন্টেন্ট পছন্দ না হলে দর্শক খুব সহজেই একই প্লাটফর্ম থেকে তার পছন্দের অন্য কন্টেন্ট দেখার সুযোগ পাবেন। তাই এ থেকে এটি স্পষ্ট যে, এ ধরনের প্ল্যাটফর্মে কোনো কন্টেন্টেই দর্শকদের জোর করে দেখানো হয় না, তারা স্বেচ্ছায়ই দেখেন (দৃশ্য–সংস্কৃতির সঙ্কটকালে ওয়েব কন্টেন্ট দমন ও নিয়ন্ত্রণের বাসনা, 2020)।
আবার একই সঙ্গে যদি আমরা লক্ষ্য করি, এই সেন্সরশিপ প্রথা আমাদের বর্তমান সময়ের কলাকুশলী ও শিল্পকে প্রতিযোগিতায় পিছিয়েও দিচ্ছে। প্রথমত, এসব সেন্সর ও এ সংক্রান্ত হয়রানির ভয় তো রয়েছেই। পাশাপাশি অনেক তরুণ লেখক, পরিচালক ও অভিনেতা এই শিল্প থেকে সরে আসছেন। একই সঙ্গে, যেহেতু এই সেন্সরশিপ শুধু দেশীয় ওটিটি প্লাটফর্মগুলোতেই সীমাবদ্ধ, তাই তারাও বাণিজ্যিকভাবে পিছিয়ে পড়ছে। তাই সীমিত হয়ে পড়ছে কলাকুশলীদের কাজ করার ক্ষেত্র। তাই আমাদের অবিলম্বে উচিৎ এই সেন্সরশিপ প্রথা বাতিল করা। তথ্যসূত্র:
- চলচ্চিত্র, চেতনা এবং সেন্সরশিপ. (2020, November 23). Net. https://www.filmfree.org/2020/07/15/etc/4913.php
- বিতর্কের মুখে সরিয়ে নেয়া হলো রগরগে ওয়েব সিরিজ ‘বুমেরাং’ ও ‘সদরঘাটের টাইগার.’ (2020, June 24). Rtvonline.Com. https://www.rtvonline.com/entertainment/97365/%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%96%E0%A7%87-%E0%A6%B8%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A7%87-%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A7%9F%E0%A6%BE-%E0%A6%B9%E0%A6%B2%E0%A7%8B-%E0%A6%B0%E0%A6%97%E0%A6%B0%E0%A6%97%E0%A7%87-%E0%A6%93%E0%A7%9F%E0%A7%87%E0%A6%AC-%E0%A6%B8%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%9C-%E0%A6%AC%E0%A7%81%E0%A6%AE%E0%A7%87%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%82-%E0%A6%93-%E0%A6%B8%E0%A6%A6%E0%A6%B0%E0%A6%98%E0%A6%BE%E0%A6%9F%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%9F%E0%A6%BE%E0%A6%87%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%B0
- দৃশ্য–সংস্কৃতির সঙ্কটকালে ওয়েব কন্টেন্ট দমন ও নিয়ন্ত্রণের বাসনা. (2020, July 15). Filmfree.Org. https://www.filmfree.org/2020/07/15/etc/4913.php
ছবিসূত্র: এই প্রবন্ধে ব্যবহৃত ছবিসমূহ ইন্টারনেটের বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগৃহীত