শিশুরা তাদের নিজস্ব কল্পনার জগতে বাস করে থাকে। সেই জগতে থাকে নানা ধরনের রং বেরংয়ের চরিত্র। সেই চরিত্রগুলো শিশুরা তাদের বেড়ে ওঠার পরিবেশের ধরনের ওপর নির্ভর করে তৈরি করে। শিশুরা তাদের পিতামাতা, পরিবারের সদস্যদের আচার–আচরণ এবং বই পড়া অথবা সিনেমায় যা দেখে ও শোনে সেসব শিশুর প্রাথমিক শিক্ষার খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই শৈশব কৈশোরে দেখা প্রতিটি চলচ্চিত্র শিশুর জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। চলচ্চিত্র দেখার মাধ্যমে একটি শিশুর সুপার হিরোর হিরোইক পাওয়ার থেকে শুরু করে হরর মুভির হাড় হিম করা ভয়ের অভিজ্ঞতা অর্জন করে। উপরন্তু একটি উপযোগী শিশুতোষ চলচ্চিত্র থেকে শিশুরা তাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা, প্রতিবন্ধকতা, সমাজের বিশ্বাস, কুসংস্কার এবং বিভিন্ন ভুল বোঝাবুঝি সম্পর্কে ধারণা পায়। কিন্তু আমাদের অত্যন্ত দু:খের বিষয় হলো আমাদের দেশে চিন্তাশীল ও মেধাবি শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাতার অভাব রয়েছে।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন দেশের চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হলেও নির্মাতাদের মধ্যে শিশুতোষ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রবণতা তেমন ছিল না। এই অনাগ্রহ এবং শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাতার অভাব এখনও বেশ প্রকট। বিভিন্ন ঘরানার চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্রমাগত প্রবণতা তার একটি ধ্রুবক প্রমাণ। স্বাধীনতার প্রায় ১০ বছর পর ১৯৮০ সালে বাদল রহমানের পরিচালনায় শিশুতোষ চলচ্চিত্র– “এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী” মুক্তি পায়। পরবর্তীকালে মোরশেদুল ইসলামের পরিচালনায় হাতেগোনা কয়েকটি শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে। “দীপু নাম্বার টু“, “আমার বন্ধু রাশেদ“, “আঁখি ও তার বন্ধুরা” পরিচালক মোরশেদুল ইসলামের কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ।
শিশু মনস্তত্ত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে শিশুতোষ চলচ্চিত্রে অ্যানিমেশনের পদ্ধতি ব্যবহার করে দারুণ সাফল্য অর্জন করে ওয়াল্ট ডিজনি। অ্যানিমেশন সিনেমার মাধ্যমে শিশুদের বিনোদন দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভীষণভাবে পিছিয়ে আছে। ২০১৯ সালে নির্মাতা মোঃ শিহাব উদ্দিনের পরিচালনায় প্রায় ১০ মিলিয়ন (এক কোটি) টাকা বাজেটে নির্মিত হয় শিশুতোষ অ্যানিমেশন “টুমোরো“ । জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট নিয়ে এই অ্যানিমেশনটি শিশুদের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এমনকি এই অ্যানিমেশনটি কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা অ্যানিমেশন ফিল্ম হিসেবে পুরষ্কার অর্জন করে। কিন্তু এই “টুমোরো” অ্যানিমেশনটি ছাড়া বাংলাদেশের শিশুতোষ চলচ্চিত্রে আর কোনো ভালো কনটেন্টের অ্যানিমেশন আছে বলে আমার জানা নেই। তাছাড়া শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকার প্রযোজকদের বিভিন্ন সুযোগ–সুবিধা দিলেও কোনো প্রযোজকই শিশুতোষ চলচ্চিত্র বানাতে আগ্রহী নন। এছাড়াও বাংলাদেশের সিনেমা হলগুলোর জরাজীর্ণ অবস্থা এবং ভালো পরিবেশ না থাকায় শিশুরাও চলচ্চিত্র থেকে অনেক দূরে রয়েছে। আমরা বিভিন্ন ঘরানার চলচ্চিত্র নির্মাণে এগিয়ে থাকলেও বর্তমানে গুণগতমানের চলচ্চিত্রের অভাব থাকায় তরুণরা এমনকি প্রাপ্তবয়স্করাও চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। সেখানে ভালো শিশুতোষ চলচ্চিত্র আশা করা আকাশ কুসুম স্বপ্ন মাত্র। বাস্তবতা হলো আমাদের এই চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কাউকে যদি একটি শিশুতোষ চলচ্চিত্র নাম জিজ্ঞেস করা হয় তাহলে বেশিরভাগ জনগণই দুই থেকে তিনটার বেশি নাম বলতে পারবেন না। কারণ এটা জোর দিয়ে বলা যায় যে আমাদের চলচ্চিত্র ইতিহাসের ২% ছবিও শিশুদের বিনোদনের কথা মাথায় রেখে বানানো হয়নি।
আমরা আমাদের সন্তানদের জন্মের পরপরই একটি নির্ভরশীল সাংস্কৃতিক বৃত্তে নিক্ষেপ করি। এছাড়া বাবা-মায়েরা অ্যানিমেশন মুভি দেখার ক্ষেত্রে তাদের সন্তানদের জন্য নির্দিষ্ট বয়স ঠিক করে দেন। কুংফু পান্ডা, ডেসপিকেবল মি, টয় স্টোরি-র মতো অসাধারণ সব অ্যানিমেশন দেখার জন্য পরিবার থেকে বয়সের বাধ্যবাধকতা থাকে। “সব ধরনের অ্যানিমেশন সব বয়সের বাচ্চাদের জন্য না”- এই দোহাই দিয়ে শিশুদের অ্যানিমেশন দেখার ক্ষেত্রে বাবা-মায়েরা বয়সের মাপকাঠি নির্ধারণ করে দেন । বর্তমানে কিছু অভিভাবকদের দেখা যায় সন্তানদের মন ভুলিয়ে খাওয়ানোর জন্য মোবাইলে অথবা টিভিতে কিছু শিক্ষামূলক অ্যানিমেশন চালিয়ে রাখেন । কিন্তু সেসব অ্যানিমেশন থেকে শিশুরা বর্ণমালার সাধারন জ্ঞান ছাড়া সৃজনশীল কোনো কিছুই আয়ত্ত করতে পারে না।
এতো কিছু সত্বেও একটি শিশু যখন কোনো ভালো মুভি অ্যানিমেশন দেখে, সেই দেখা পর্যন্তই শেষ। শিশুকে তার নতুন দেখা মুভি বা অ্যানিমেশনটিকে নিজের মনের মধ্যেই রাখতে হয়। কারণ বাবা–মায়েরা নতুন অ্যানিমেশন দেখতে শিশুদের খুব একটা উদ্বুদ্ধ করেন না এমনকি নতুন কোনো অ্যানিমেশন বা মুভি দেখার পর সেটা নিয়ে সন্তানদের সাথে কোনো আলোচনা করার কোনো প্রবণতা দেখা যায় না।
অতীতের শিশুরাই তরুণ্যের সীমানা পেরিয়ে ভবিষ্যত গড়ার লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু যারা তাদের শৈশবে, কৈশোরে শিশুতোষ চলচ্চিত্রের কোনো ধারণা পায়নি, যে শিশুটি চলচ্চিত্র ছাড়া বড় হয়েছে সে তার জীবনে চলচ্চিত্রপ্রেমী কিভাবে হতে পারে? এ প্রশ্ন গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে। আমরা যদি নতুন প্রজন্মকে চলচ্চিত্র প্রেমী করতে চাই, তাহলে আমাদের বর্তমান শিশুদের ভালো চলচ্চিত্র উপহার দেওয়ার দৃঢ় সংকল্প করতে হবে। আমাদেরকে শিশুদের উপযোগী উপভোগ্য চলচ্চিত্র উপহার দিতে হবে। তাদের এমন ধরনের চলচ্চিত্র উপহার দিতে হবে যা তাদেরকে প্রকৃত দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তুলতে এবং নিজের দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান লাভের সহায়তা করবে এবং একই সঙ্গে সৃজনশীল চিন্তাভাবনা বাড়াতে সাহায্য করবে। প্রযুক্তি ও সংস্কৃতির সংমিশ্রণে বিচক্ষণ মানসিকতা নিয়ে শিশুরা বড় হবে।
কিন্তু যে শিশুরা বছরের–পর–বছর ধরে উন্নত চলচ্চিত্র থেকে বঞ্চিত থেকে গেছে সেই ঘাটতি পূরণ করা বর্তমানে আদৌ সম্ভব কিনা সেটা বড় প্রশ্ন।