ষাটের দশকে বাংলাদেশে স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা আন্দোলন এবং ভিয়েতনাম, আলজেরিয়া, প্যালেস্টাইনে ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে বাঁচতে মুক্তি সংগ্রাম, দুটোই তৎকালীন বিশ্ব রাজনীতিতে অস্থির সময়ের সূত্রপাত করেছিলো। ইতিহাসের একটি চরম বিন্দুতে দাঁড়িয়ে একজন শিল্পী হিসেবে আলমগীর কবির তাঁর সময়কে উপেক্ষা করতে পারেননি। ষাটের দশকের বিদ্রোহ এবং নিজের জীবন অভিজ্ঞতা নিয়ে নির্মাণ করলেন আত্মজৈবনিক চলচ্চিত্র রূপালী সৈকতে।
ষাটের দশকে পূর্ব বাংলার জনগণের উপর পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তির নিপীড়ন প্রবণতা এবং বিশ্বের অন্যান্য জনপদে ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রতিবাদ-সংগ্রামকে Cinema verite* – এর আঙ্গিকে তুলে ধরা হয়েছে এই চলচ্চিত্রে। এর স্বপক্ষে মোকাম্মেল (২০১৭) বলেন, “প্রথম যৌবনে পশ্চিমের ছোঁয়া ও যে চলচ্চিত্রিক আবহে আলমগীর কবির নিজেকে পেতে চেয়েছেন, তাতে তাঁর পক্ষে স্বাভাবিকই ছিল প্রচলিত ধারায় গল্প বলার চেয়ে ষাট দশকের রাজনৈতিক চলচ্চিত্রকারদের প্রিয় মাধ্যম সিনেমা ভেরিতের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠা।“ আত্মজৈবনিক এ চলচ্চিত্রে সমকালীন বিশ্ব পরিস্থিতিতে ঔপনিবেশিক নিপীড়নে বিপর্যস্ত বৈশ্বিক জনপদ এবং পরিচালকের নিজ জনপদের মানুষদের কথা সমান্তরালভাবে স্পন্দিত হয়।
রূপালী সৈকতে অসংখ্য ঘটনাপ্রবাহ এবং চরিত্রের সংযোজন ঘটিয়ে ষাটের দশকের স্বরূপ তুলে এনেছেন আলমগীর কবির। এই চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র লেনিন চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স ও লন্ডনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যাথমেটিক্সে বি.এস.সি. সম্পন্ন করে যোগ দেন ব্রিটিশ কম্যুনিস্ট পার্টির মুখপত্র ডেইলি ওয়ার্কার-এ। সক্রিয় ছিলেন ইস্ট পাকিস্তান হাইজ ও ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট -এর আন্দোলনে। গেরিলা প্রশিক্ষণ নিতে কিউবা ও আলজেরিয়া গমন করেন। দেশে এসে জড়িয়ে পড়েন আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে। লেনিন চরিত্রটি পুরো আলমগীর কবিরেরই প্রতিবিম্ব। আনোয়ার চরিত্রটি আলমগীর কবিরের প্যালেস্টাইন মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণের চিত্র রূপায়ণ করে। আনোয়ার যখন আনার কাছে তার প্যালেস্টাইন জীবনের কাহিনী বর্ণনা করে, তখন সিনেমা ভেরিতের আঙ্গিকে যুদ্ধ বিধ্বস্ত প্যালেস্টাইনের বিভিন্ন খন্ড খন্ড প্রামাণ্য চিত্র জুড়ে দেয়া হয় দৃশ্যের মাঝে, যা কিনা দর্শককে স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের মতো তাদেরও মুক্তি দরকার। সমকালীন বিশ্ব রাজনীতি সম্পর্কে আলমগীর কবির যে সচেতন ছিলেন, তা তাঁর নিজ জনপদের মুক্তি সংগ্রামের সমান্তরালে ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রামের প্রসঙ্গ টেনে আনার মাধ্যমে জানা যায়।
ষাটের দশকে তৎকালীন বুদ্ধিজীবীদের জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত হয়ে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠা এবং ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির প্রশ্নে আপোষকামী হওয়া ও লেজুড়বৃত্তি করার ঘটনা উঠে এসেছে এই চলচ্চিত্রে। একশ্রেণীর লোক ছিলেন যারা সাম্রাজ্যবাদী শাসকচক্রের হাত থেকে মুক্তি পেতে সোচ্চার ছিলেন। এদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. মাহমুদ হোসেন ও জহির রায়হান ছিলেন বাস্তব চরিত্র। শাসকশ্রেণীর ভাড়াটে গুন্ডাবাহিনীর হামলায় আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তিরত ড. মাহমুদ, যেখানে বাস্তবের ড. মাহমুদ হোসেন অভিনয় করেছেন, এক সাক্ষাৎকারে সাফ জানিয়ে দেন যে এই আক্রমণের কারণে তিনি তাঁর মতবাদ থেকে সরে দাঁড়াবেন না। জহির রায়হানের বেলাতেও দেখা যায় স্বৈরাচারী শাসকচক্র তাঁর জীবন থেকে নেয়া চলচ্চিত্রটি প্রোডাকশন স্টেজে বন্ধ করে দিতে চায়। তিনি দমে যাননি। চলচ্চিত্রে স্বৈরাচারী শাসনকে প্রতীকীরূপে দেখিয়েছেন। আলমগীর কবির জীবন থেকে নেয়া চলচ্চিত্রের সেট থেকে ১৬ মি.মি. ক্যামেরায় ধারণ করা কিছু ফুটেজ দৃশ্যে জুড়ে দেন যেখানে দেখা যায় বাস্তবের জহির রায়হান তাঁর অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দৃশ্য বুঝিয়ে দিচ্ছেন। রূপালী সৈকতে চলচ্চিত্রের চলচ্চিত্রকার এই বাস্তব চরিত্রগুলো ব্যবহার করেছেন তাঁদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে। অন্যদিকে, আরেক শ্রেণীর ব্যক্তি ছিলেন যারা স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোষকামী এবং আপন স্বার্থ কায়েমে লেজুড়বৃত্তি প্রবণ। ‘দি ডেইলি নিউজ’ এর সম্পাদক এমনই একজন। টেলিফোনে উপরওয়ালার কথামতো তিনি লেনিনকে ডেকে পাঠান এবং তাকে অটোনমির ওপর করা পোস্ট এডিটোরিয়ালটা বন্ধ করার আদেশ দেন। রাওয়ালপিন্ডি থেকে চাপ এসেছে বলে এদেশের মানুষের বাঁচা মরার প্রশ্ন চেপে যেতে লেনিন আপত্তি জানালে, সম্পাদক তাকে মনে করিয়ে দিতে চান ফিল্ড মার্শালের রাজত্বে বাস করে এরকম কথা সে বলতে পারে না। জনগণের ন্যায্য অধিকার ও আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা বলার স্বাধীনতা যদি খর্বই হতে থাকে, তাহলে পত্রিকায় কাজ করার কোন অর্থ খুঁজে পায় না লেনিন। চাকরি থেকে পদত্যাগ করে সে। অথচ, এই সম্পাদকের কলম দিয়ে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে আগুন ঝরেছিল। এখন নির্বিঘ্নে পরিবারের সাথে জীবন কাটানোর আশায় তিনি আপোষকামী হলেন। একই সময়ে সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক মিজানুর রহমানকে লেজুড়বৃত্তি করতে দেখা যায়। তার কলেজের অধ্যক্ষকে নিয়ে সমালোচনা করে আর্টিকেল লেখায় তিনি লেনিনের কাছে তেড়ে আসেন। লেনিন ও আসলাম অবাক হয়ে যান। এরকম শিক্ষিত, মার্জিত একটা ছেলে চাকরি বাঁচানোর জন্য এমন মেরুদন্ডহীনের মতো আচরণ করতে পারে। সুনীল মন্তব্য করে, “সেটাইত আইয়ুবের biggest success. অধিকাংশ বাঙালি ইন্টেলেকচুয়ালসদের মাখন মাংস খাইয়ে এক্কেবারে হামা বানিয়ে ফেলছে।” লেজুড়বৃত্তি করেও রক্ষা পায়নি মিজান। সরকার সমর্থিত গুন্ডারা গাড়ি থামিয়ে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যায় তার স্ত্রীকে। বিভিন্ন জায়গায় টেলিফোন করে নিজের পরিচয় জানিয়ে সাহায্য চাইলে প্রত্যাখ্যাত হয়। এমনকি গভর্নর হাউজ থেকেও সাহায্য পায়নি সে। মিজানের ঘটনাটি তৎকালীন সমাজে সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তাহীনতার চিত্রটিই তুলে ধরে।
১৯৬৬ সালে দেশে ফিরে বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন আলমগীর কবির। আইয়ুব সরকারের হাতে গ্রেফতার হয়ে জেল খাটেন কয়েকমাস এবং জেল থেকে ছাড়া পেয়ে নজরবন্দী থাকেন এক বছর (বাংলাপিডিয়া, ২০১৪)। চলচ্চিত্রের লেনিনও সমকালীন বামপন্থী রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন এবং পরবর্তীতে নিজ দলের লোকদের বিশ্বাসঘাতকতায় কারারুদ্ধ হন।
সে সময়ে স্বাধীনতার প্রশ্নে বামপন্থী নেতাদেরও সোচ্চার হতে দেখা যায় না। একপক্ষ স্বাধীনতা আদায়ের আশা করলেও নেই কোনো পর্যাপ্ত কার্যক্রম। অপরপক্ষ ছয় দফাকে সি.আই.এ-র প্লট দাবি করে স্বাধীনতার প্রশ্নে চুপ করে থাকে। এক বামপন্থী নেতার সাথে লেনিনের কথোপকথনে বিষয়গুলো ফুটে উঠে। লেনিন মনে করে এসব বলে বিরোধীপক্ষ আসলে যুদ্ধ থেকে দূরে থাকতে চাইছে। যুদ্ধ করতে এরা ভয় পাচ্ছে, তাই এত টালবাহানা। লেনিন তার রাজনৈতিক জ্ঞান দিয়ে বুঝতে পারে কিছু একটা হচ্ছে। তাই সে নেতাকে তাড়া দেয় ক্যাডারদের ট্রেনিং দেয়ার জন্য। ল্যাজা, বল্লম, পাইপ গান দিয়ে গুপ্তহত্যা করা যেতে পারে, কিন্তু পাকিস্তান আর্মির মতো একটা মডার্ন মেশিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যায় না। এ থেকে স্পষ্ট হয় যে কারো কোরো পূর্ণ প্রস্তুতি নেই। লেনিন রাজনৈতিক নেতাদের জনবিচ্ছিন্নতায় ক্ষোভ প্রকাশ করে। তারা এতো বছর ধরে রাজনীতি করছে, অথচ জনগণ আজও ধরতে পারলো না তাদের রাজনীতিটা কি! লেনিন পুরোপুরি এর বিপরীত। সে তার কর্মীদের বলে, “আমরা মুক্তি সংগ্রামে যেতে চাচ্ছি কেবল বিদেশি শাসক ও শোষকদের হটিয়ে দেশীয় রক্তচোষাদের জায়গা করে দিতে নয়৷ আমরা যদি সত্যিই এদেশে শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা চাই তাহলে জনগণকে সঙ্গে রেখেই আমাদের এগুতে হবে। আর সেজন্য প্রথমেই প্রয়োজন জনগণের সাথে রাজনৈতিক যোগাযোগ।“
মতগত অমিলের কারণে বিরোধীপক্ষের বিশ্বাসঘাতকতায় গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করতে হয় লেনিনকে। বামপন্থী আন্দোলনে থেকেও তাদের রাজনীতি পছন্দ হয় না লেনিনের। তাই, স্বাধীনতার প্রশ্নে একপক্ষের উপর্যুক্ত কার্যাবলীর অভাব এবং অপরপক্ষে ছয় দফাকে সি.আই.এ-র প্লট দাবি করা লেনিনের কাছে প্রহসনের নামান্তর। আলমগীর কবিরের বামপন্থী রাজনৈতিক জীবনের চিত্র উঠে আসে লেনিনের চরিত্র রূপায়ণের মধ্য দিয়ে। আক্তার (২০১১) বলেন, “শুধুমাত্র বাহ্যিক ঘটনাক্রমের ধারাবাহিকতায়ই নয় সার্বিক দিক থেকে লেনিনের ব্যক্তি জীবন, রাজনৈতিক জীবন ও অন্তর বৈশিষ্ট্য আলমগীর কবিরের ব্যক্তি বৈশিষ্ট্যের ছাঁচে গড়া।“
আলমগীর কবির ষাটের দশকের বাংলাদেশ ও কিউবা, আলজেরিয়া ও প্যালেস্টাইন মুক্তি সংগ্রামের সঙ্গে জড়িত থেকে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন তা দিয়েই একটি আত্মজৈবনিক চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রয়াস পান। সমকালীন বাংলাদেশ এবং বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের রাজনৈতিক অবস্থার চিত্র সচেতনভাবে ফুটে উঠেছে রূপালী সৈকতে। মোকাম্মেল (২০১৭) বলেন, “একজন রাজনৈতিক চলচ্চিত্রকার হিসেবে আলমগীর কবিরের গুরুত্ব এই সত্যে নিহিত যে, অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে তিনি ষাটের দশকের অস্থির সময়ের নাড়িটিকে ছুঁতে পেরেছেন।“ Cinema verite-এর আঙ্গিকে যুদ্ধ বিধ্বস্ত ভিয়েতনাম, প্যালেস্টাইন এর খণ্ড খণ্ড প্রামাণ্যচিত্র যোজনের মাধ্যমে আলমগীর কবির তাদের মুক্তির দাবিকে সমর্থন জানিয়েছেন এবং গ্রহণযোগ্য করে তুলেছেন। ইতিহাসের একটি চরম সময় এবং নিজের ব্যক্তি জীবন ও রাজনৈতিক জীবনকে উপজীব্য করে আলমগীর কবির যে সচেতন রাজনৈতিক চলচ্চিত্র বানিয়েছেন রূপালী সৈকতে তারই স্মারক মাত্র।
তথ্যসূ্ত্র:
ক। আক্তার, ফাহমিদা (২০১১), ষাটের দশকের ইস্তেহার ও আলমগীর কবিরের আত্ম-আবিষ্কারের চলচ্চিত্র রূপালী সৈকতে, ষান্মাসিক জার্নাল, ৪র্থ সংখ্যা, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ, ঢাকা।
খ। মোকাম্মেল, তানভীর (২০১৭), সিনেমার শিল্পরূপ, আলমগীর কবির: বায়োস্কোপের দেশে একজন অতঁর পরিচালক, অনার্য, পল্টন, ঢাকা-১০০০।
গ। কবির, আলমগীর। বাংলাপিডিয়া (২০১৪)।
টীকা:
*Cinema verite (truth cinema) is a style of documentary filmmaking. It is largely concerned with the recording of events in which the subject and audience become unaware of the camera’s presence. Cinema verite can involve stylized set-ups and the interaction between the filmmaker and the subject. It combines improvisation with the use of the camera to unveil truth or highlight subjects hidden behind crude reality. (en.m.wikipedia.org).
ছবিসূত্র: এই প্রবন্ধে ব্যবহৃত ছবিসমূহ বিভিন্ন ইন্টারনেট সূত্র থেকে সংগৃহীত