কমলা রকেট সিনেমাটি যারা দেখেছেন তারা এই সিনেমার ব্যাপারে অনেক কিছুই বলে থাকেন । কেউ একটু বেশিই প্রশংসা করে ফেলেন। আবার কেউ প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশি খুঁত ধরার চেষ্টা করেন। আমি যদি সহজে বলতে চাই, কমলা রকেট এমন কিছু করতে সক্ষম হয়েছে যা সমসাময়িক বাংলা চলচ্চিত্রে সচরাচর দেখতে পাওয়া যায় না।
আগেই বলে নিই, আমার কথাগুলো কমলা রকেটের কোন পর্যালোচনা নয় (হয়ত পাঠক আমার প্রথম প্যারার শেষ লাইনকেই আমার রিভিউ হিসেবে ধরে নিতে পারেন)। আর, আমার জ্ঞ্যানের স্বল্পতার কারণে আমি ছবিটিকে সমসাময়িক বাংলা চলচ্চিত্রের মধ্যে এর অবস্থানকে বিবেচনা করেও ব্যাখ্যা করতে পারবো না। তবে ব্যাক্তিগতভাবে উপলব্ধি করা কিছু বিষয় আমি তুলে ধরবো। আমার মতে এই বিষয়গুলো কমলা রকেটকে নিঃসন্দেহে আলাদা করে।
আর আমি ধরে নিচ্ছি পাঠক সিনেমাটি দেখেছেন, তাই প্লট বর্ণনার ঝামেলাটা এড়িয়ে গেলাম।
মানবিকতা ও ধূসরতাঃ
কমলা রকেটে যে মানবিকতার স্বচ্ছ উপস্থাপনা করা হয়েছে, তা আমার মতো প্রতিটি দর্শকেরই চোখে পড়ার কথা। ছবির প্রতিটি অংশেই এই বিষয়টা এতো প্রকটভাবে উপস্থিত যে সবচেয়ে অলস দর্শকেরও চোখ এড়ানোর উপায় নেই। এই উপমহাদেশীয় ছবিতে এটা কোন বিষয়ই না, তবে কমলা রকেট এর সফল উপস্থাপন একটি আদর্শ উদাহরন। কারন এদেশীয় চলচ্চিত্রে মানবিকতা দেখাতে যেয়ে অতিরঞ্জিত করা হয়। এতে কার্টুনের মতো কিছু চরিত্রের আবির্ভাব ঘটে। এর পেছনে বড় একটা ভুমিকা রাখে পরিমিতিবোধ। দর্শকের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে গল্পকে স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। চামচ দিয়ে গেলানোর চেষ্টা করা হয়নি। গল্পের বাস্তবতায় চরিত্রগুলোকে উপস্থাপন করা হয়েছে শুধু, তাদের ওপর কোন রকম মন্তব্য করা হয়নি। এতে দর্শকের ভুমিকাটা অনেকটা মুখ্য হয়ে ওঠে। ফলে সিনেমাটি দর্শকের সক্রিয় মনোযোগ দাবি করে। সেই সাথে দর্শকও হয়ে ওঠেন সচেতন দর্শক।
একটা প্রশ্ন মনে জাগে, কমলা রকেটের মূল চরিত্র কে? বীমার অর্থের লোভে নিজের ফ্যাক্টরি পুড়িয়ে পলাতক আতিক? নাকি এই হত্যাকান্ডের ভুক্তভোগী মনসুর? অনেকে হয়ত মফিজুর এর চরিত্রকেই মুখ্য হিসেবে ধরে নিবেন। আবার হয়ত অনেকে বলবেন লাশটাই হয়ত এর মূল চরিত্র। কারণ, এই অকাল মৃত্যুটা না হলে গল্পে যা ঘটে তার অনেককিছুই ঘটতো না। তবে আমার মনে হয় এই গল্পের কোন মুল চরিত্র নেই। নদীর মত বহমান জীবনধারাকে লেখক–পরিচালক জুটি আমাদের কাছে প্রকাশ করেছেন মাত্র। হয়ত আমরাই এর প্রধান চরিত্র। আমাদের সামনে নগ্ন মানবিকতা কে তুলে ধরা হয়েছে শুধু।
কমলা রকেটকে এক দৃষ্টিতে মানুষের মৌলিকতার একটা গবেষণা বলা যেতে পারে। মানবিকতার প্রতিফলন মূলত দেখানো হয়েছে চরিত্রগুলোর মাধ্যমে। আতিক নামক চরিত্রটা দিয়েই শুরু করা যাক। প্রথম যখন সে স্টিমারে চড়ে বসে তখন তাকে বেশ ঠান্ডা স্নায়ুর, দাম্ভিক আর কিছুটা ধূর্তও মনে হয়। তালাবন্ধ ফ্যাক্টরির আড়ালে শত শত কর্মীদের হত্যা করে সুন্দরবনে পালিয়ে যাচ্ছে সে; সবকিছু তার নিয়ন্ত্রনে। প্রেসকে কি বলতে হবে, ক্ষতিপূরনের কত টাকা দিতে হবে, সব সে ভেবে রেখেছে।
কিন্তু, রকেট যখন আস্তে আস্তে খুলনার পথে যাত্রা করতে থাকে, আতিকের অভিজ্ঞতা হয় সমাজের ভিন্ন শ্রেণীর মানুষ সম্পর্কে । স্টিমারের নোংরা রান্নাঘরের খাবার যাতে খেতে না হয় সেই ভয়ে আতিক ফাস্টফুড নিয়ে এসেছিল। সেসব তো একদিনেই নষ্ট হয়ে যায়। আর তার সাথে যে ধনী পরিবার ভ্রমণ করছে তাদের সাথে খাওয়ার অনুরোধও সে নাকচ করে দিয়েছে। অগত্যা তাকে মফিজুরের শরণাপন্ন হতে হয়, কখন বা কোথায় খাবার পাওয়া যাবে এসব জানার জন্য। সেই মফিজুর, যাকে আতিক “আউট!” বলে তাড়িয়ে দিয়েছিলো, যার শোয়ার ঘরে ঢুকে সে নাক সিঁটকেছে।
মফিজুরের প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি।
ভেবেছিলাম ফ্রেম, কম্পোজিশন নিয়ে কিছু বলবো না। তবে একটা ফ্রেমের কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। ছবির শেষদিকে যখন আতিক ক্ষুধায় কাতর হয়ে প্রথম শ্রেনীর কেবিনগুলো থেকে বেরিয়ে আসে, তার আগমুহুর্তেই তাকে ‘১ম শেণী’র দরজায় বন্দী হিসেবে দেখা যায়। উচ্চমার্গীয় চালচলন, বেশভুষা, কথাবার্তা দিয়ে যে মেকি শ্রেনীতে সে অবস্থান করে, সেখানে যেন সে নিজেই বন্দী। কিন্তু ওই যে, ক্ষুধার মৌলিক জ্বালা। ওখান থেকে শুরু হয় আতিকের নিচের দিকের যাত্রা। নিচেরতলায় আবার খাবারের জন্য লম্বা লাইন। খুব বেশি খাবার যে নেই। কে ধনী? কে গরীব? সবাই দাঁড়িয়ে আধপ্লেট ভাত আর একটু ডালের আশায়। মানুষের সাথে দাঁড়িয়ে আছে গবাদিপশুও। যে ধনী ব্যাবসায়ী তাচ্ছিল্য করে বলেছিল, “তোমাদের রান্না খাই, আর স্যালাইনের প্যাকেট নিয়া দৌড়াদৌড়ি করি! ” তাকেও সপরিবারে লাইনে দেখা যায়।
আর যখন আতিক জানতে পারে পঁচে যাওয়া লাশটা তারই ফ্যাক্টরির শ্রমিকের, তখন তার ধূর্ততা, চালাকি সব ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। শাহাদুজ্জামানের “মৌলিক” গল্পের নির্যাসটাই যেন এমন। মানুষের শ্রেণী যাই হোক না কেন, তার ক্ষুধা লাগে, মরে গেলে পঁচে গন্ধ বের হয়।
দিশি চরিত্রটা বেশ ধূসর আর অনিশ্চিত। যেন বাংলাদেশি যুবক সমাজের একটা বড় অংশের রুপক সে। পেশা, প্রেম, যৌনতা, নীতি সবকিছু নিয়েই তাকে অনিশ্চিত এবং আবেগপ্রবন হিসেবে দেখা যায়। একটা মজার ব্যাপার দিশিকে একই সাথে নারীবাদী এবং নারীবাদবিরোধী চরিত্র বলা যায়। তবে আমার কাছে তার জনসেবার কপটতা বেশি মানবিক মনে হয়েছে। দেখানো হয় যে দিশি তার এনজিওর মাধ্যমে গরীব–দুঃখী মানুষদের সাহায্য করতে চায়। তবে বিসিএস প্রিলিমিনারিতে নির্বাচিত হওয়া মাত্রই সে সরকারি চাকরির স্বপ্ন দেখতে থাকে। তার “হোপ” ফাউন্ডেশনের ভবিষ্যত হয়ত আশাহীন হয়ে দাঁড়ায়। তবে এখানে তাকে দুই কারণে সহজে দোষারোপ করা যায় না। প্রথমত, মানুষ এমনই হয়। আর এক পর্যায়ে দিশি বলে যে, সে তার সরকারি অবস্থানের ক্ষমতাবলে অসহায় মানুষদের সাহায্য করবে। এই যে ধূসরতায় রেখে দেয়া, ভালো আর খারাপের মাঝে দোদুল্যমান একটা অবস্থা দেখানো, এটাই দিশি চরিত্রকে দর্শকের কাছে তাকে আরো বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
শাহাদুজ্জামানের “সাইপ্রাস” ছোটগল্প থেকে নেয়া মফিজুর চরিত্রটি কমলা রকেটের সবচেয়ে মজাদার আর মনে রাখার মত চরিত্র। কমলা রকেটের নিয়মিত যাত্রী সে। স্টিমারের সকল শ্রেণীতেই তার বিচরণ। সে যেমন কমবয়সী যুবকদের সাথে হাস্যরসে মেতে ওঠে, তেমন বন্ধুর স্ত্রীর মৃত্যুশোকে তাকে স্বান্তনা দেয়, সহানুভুতিতে তার চোখ ভিজে যায়। উচ্চশ্রেনীর আতিকের সাথে সে হুজুর হুজুর করে, আবার খেটেখাওয়া সার্কাসকর্মীদের সাথেও সে বন্ধুর মতো আচরণ করে। কবি, কবিরাজ ও গণিকার দালাল মফিজুর এর পেশাই যেন তাকে এমন মিশুক হতে বাধ্য করে। এক পর্যায়ে সে আতিককে বলে ফেলে (যেন দর্শকের উদ্দেশ্যেই) সে তো খারাপ মানুষ না। তারও ছেলেমেয়ে আছে, স্বপ্ন আছে, এজন্যেই তাকে স্টিমারে স্টিমারে ঘুরতে হয়। তার মাধ্যমে আমরা সমাজের ভিন্ন শ্রেনীর সুখ–দুঃখ জানতে পারি। ভদ্রসমাজের চোখে কটু এমন পেশার একজন চরিত্রের প্রতি দর্শকের সহানুভূতি আনাটা সহজ কাজ নয়।
দৃশ্যের গভীরতাঃ
একটি ভালো দৃশ্য কিভাবে বানানো যায়? ফ্রেমগুলো নান্দনিকতায় আর সৌন্দর্যে ভরা থাকবে? খুব ভাল ডায়লগ থাকতে হবে? হ্যাঁ, এসব থাকাটা সুবিধার, তবে সাবটেক্সট ছাড়া তা দুর্বল হয়ে পড়ে। অর্থাৎ ফ্রেমে যা দেখা যায় তার বাইরের গল্প। আর ফ্রেমে যা দেখা যায় তার অর্থেও গভীরতা থাকতে হবে। কমলা রকেটের বেশিরভাগ দৃশ্যেই এমন গভীরতা ছিল। ইংরেজিতে যাকে “নিউওন্সড সিন” বলা যেতে পারে। দু’একটা উদাহরন দিলে তা আরো ভালোভাবে বোঝা যাবে।
- আতিক যখন তার কেবিনে প্রবেশ করে, তখন তাকে তার আশেপাশে দামি পারফিউম স্প্রে করতে দেখা যায়। তার মত উঁচুশ্রেনীয় ব্যাক্তির কাছে স্টিমারের প্রথম শ্রেনীর গন্ধও অসহ্য মনে হয়। কিন্তু, ছবি শেষ হতে হতে আমরা দেখতে পাই, আতিকের কর্মফলের দুর্গন্ধ নিতে তাকে নিম্নশ্রেনীর ডেকে নামতে হয়।
- কুয়াশায় আটকে থাকা একটি দৃশ্যে আমরা আতিক এবং মনসুরকে প্রথমবার এক ফ্রেমে দেখতে পারি। উপরতলায় আতিক আর নিচতলায় মনসুর, সিগারেট খাচ্ছে। সাংকেতিক ভাবে এখানে যেমন শোষক আর শোষিতের শ্রেনীবৈষম্য দেখানো হয়, তেমনি দুজনের আশু সাক্ষাতের প্রতিও নির্দেশ করা হয়।
- মফিজের ওস্তাদ যখন গেয়ে ওঠে:
“হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান এক মায়ের সন্তান
যার যার কর্ম সে সে করে, কেউ কারো ক্ষতি চায়না…”
তখন সাথে সাথে আতিকের চেহারায় উৎকণ্ঠা দেখা যায়। গানের কথাগুলো যে তার মধ্যে পাপবোধ জাগিয়ে তোলে এটা বুঝতে দর্শকের দেরী হয়না।
- যখন আতিক আর মনসুরকে আমরা পরবর্তীতে আরেকবার একসাথে দেখতে পাই, তখন তাদের মধ্যে একটা আদান–প্রদান হয়। মনসুরের ম্যাচ দিয়ে আতিক সিগারেট জ্বালায়। যে আগুনে আতিক মনসুরের স্ত্রীসহ শতেক কর্মীকে পুড়িয়ে নিজের স্বার্থ অর্জন করেছে, সেই আগুনই আবার মনসুর আতিককে ফিরিয়ে দেয়।
অনিশ্চিত সমাপ্তি:
সিনেমার জন্য ভালো গল্প নির্বাচন করা/লেখা নির্মাতাদের জন্য একটা বড় বাঁধা। তবে ভালো গল্প নির্বাচনের সুফল পাঠক একটু পরেই বুঝতে পারবেন।
কমলা রকেটের সমাপ্তিতে গল্পটা অসম্পুর্ণ রাখা হয়। যখন শেষ দৃশ্যে ক্যামেরা ডলি–আউট হতে থাকে, আমরা দর্শক রাতের অন্ধকারে কমলা রকেট থেকে দূরে সরে আসতে থাকি। আমাদের মনে অনেকগুলো আবেগ, আর কিছু প্রশ্ন।
এবার ভাবুন, এই সমাপ্তিটা যদি “মেলোড্রামাটিক” আর “পিপল – প্লিজিং” হতো? আতিক যখন বুঝতে পারলো পঁচা লাশটা তার ফ্যাক্টরীর কর্মীর, সাথে সাথে সে দৌঁড়ে বেরিয়ে এলো ওয়াক ওয়াক করতে করতে। ডেকে বেরিয়েই দেখল চারপাশে কোস্টগার্ড আর পুলিশের বোট। সার্চলাইটের আলো পড়ছে তার হতভম্ব চেহারায়। মনসুর আর মফিজুরও অবাক।
প্রথমে পরিচালক নূর ইমরান মিঠু তার ছবির জন্য এমন সমাপ্তিই চেয়েছিলেন, একটা জাঁকজমকপূর্ণ সমাপ্তি। এমনটা করলে হয়ত দর্শকের চোখ ধাঁধাতো এবং তাদের ভালো লাগতো। কিন্তু মূল সমাপ্তির শেষে যে আবেগী আর প্রশ্নপুর্ণ রেশ থেকে যায় সেটা আর থাকতো না তখন। এজন্যই শাহাদুজ্জামান জোর করেন, যাতে সমাপ্তিটা পাল্টে দেয়া হয়।
ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত