সিনেমা যে বিনোদনের অন্যতমপ্রধান মাধ্যম তা নতুন করে বলার কিছু নেই। সিনেমার মতো শক্তিশালীমাধ্যম আর দ্বিতীইয়টিও নেই। তাই তো ঋত্বিক ঘটক বলেছিলেন “সিনেমার চেয়ে অন্য কোন শক্তিশালী মাধ্যম থাকলে কবেই লাথি মেরে চলে যেতাম” সিনেমার মতো সিনেমা হলও ঠিক ততোটাই গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতাপূর্ব ওপরবর্তী সময়ে সকল শ্রেণী-পেশারমানুষের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যমছিল সিনেমা হল। স্বাধীনতার পর এদেশে অসংখ্য সিনেমা হল নির্মিত হয়। সময়ের বিবর্তনে চলচ্চিত্র শিল্পের আকাশ সংস্কৃতির (ডিশ) প্রভাবে সাধারণ দর্শক হল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। যার ফলে অসংখ্য সিনেমা হল কালের করাল গ্রাসে বিলীন হয়ে বহুতল শপিং কমপ্লেক্সে পরিণত হয়েছে। তবে এখনও বলাকা, মধুমিতা, সনি, সেনা অডিটোরিয়াম, রাজলক্ষ্মী, অভিসার চিত্রাসহ উলেখযোগ্য কিছু সিনেমা হল তাদের নিজম্ব স্বকীয়তায় এখনো টিকে আছে।
সিনেমা হল নিয়ে আমি সব সময় একটা অন্যরকম টান বোধ করি। সে বোধ থেকেই একদিন বেড়িয়ে পরলাম । প্রথমেই চলে গেলাম পুরান ঢাকায়। আজাদ সিনেমা হল। সাথে আমার এক বন্ধু। সে ওখানকার স্থানীয় | জানালো, আজাদ সিনেমা হল এর অবস্থা খুব নাজুক । বলল, ওখানে নাকি ‘এডাল্ট ফিলা’ দেখানো হয়। আর বেশির ভাগই দেখতে আসে স্কুলের ছেলেরা । সেদিন শুক্রবার হওয়ায় মনে করেছিলাম অনেক ভিড় হবে। কিন্তু না, কোন ভিড়ই ছিল না। কথা হল আজাদ সিনেমা হলের ম্যানেজার পরিতোষ রায়ের সাথে । তার কাছ থেকে হতাশার কথাই বেশি শুনলাম । আগের সেই রমরমা অবস্থা নেই, নেই হলের সেই জৌলুসও। মালিক টাকা দিতে পারেন না বলে কর্মী মাত্র দুই। পরিতোষ রায় ও তার এক সহকারি। টাকার অভাবে বড় বাজেটের ছবিগুলো আনা হয় না। শুধু ঈদের সময়ই যা কিছু লোকজন আসেন । তারা হলেন দিনমজুর, রিক্সাওয়ালা, ট্রাক ড্রাইভারসহ শ্রমজীবী মানুষ । মধ্যবিত্তদের দেখা খুব একটা মেলেনা । অথচ, এই হলেই “ছুটিরঘন্টা” মুক্তি পাবার পর চারটা শো এর বদলে বাধ্য হয়ে ৫টা শো করতে হয়েছিল । আর তার ৯০ শতাংশ দর্শকই ছিল মধ্যবিত্ত । কথাবার্তা চলছে খুব তাড়াতাড়ি। তিনি জানালেন, আজাদ সিনেমা হল এর জায়গায় গড়ে উঠবে বহুতল বিশিষ্ট সুপার মল। হয়তো সেখানে সিনেপ্লেক্স এর মতো কিছু একটা থাকতে পারে। তার গলা ভারি হয়ে এলো । আমি বিদায় নিয়ে চলে আসলাম।
এরপর গেলাম মানসী সিনেমা হল-এ। বেশ বেগ পেতে হয়েছিল খুঁজে পেতে । অনেক অলিগলি পার করে যখন পৌঁছালাম দেখে একদমই মনে হচ্ছিল না যে এটা কোন সিনেমা হল। কারণ, সামনে সবজির ভ্যান, দোকান। মানুষ কেনাবেচা করছে। কাউন্টারে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ম্যানেজার কই? তার সাথে কথা বলবো। লোকটা পাত্তাই দিলনা । এতে আমার মেজাজটা একটু চড়ে যায়। তখনি একজন বয়স্ক লোক এসে আমাকে বলতে থাকেন কি চান? কই যাবেন? কাকে চান? আমি কিছুটা ক্ষেপে গেলে আমার বন্ধু ব্যাপারটা সামলে নিল। তার সাথে আমাদের নিয়ে গেলেন দোতলায়। একটা অফিসে নিয়ে বসালেন। শুনতে চাইলেন আমরা কি জানতে চাই? আমি বললাম আমি ম্যানেজারেওর সাথে কথা বলবো। জানালেন, তিনিই ম্যানেজার।
‘আমার নাম খোরশেদ আলম । ‘এই মানুঘটাই একটু আগে নিচে ফ্লোর পরিষ্কার করছিলেন। তিনি নিজেই পরে আমার সব দ্বিধা দূর করলেন। ব্যবসায় মন্দা, তাই মালিক আআর চালাতে পারছেন না। সব কর্মচারী চলে গেছেন। শুধু তিনি রয়ে গেছেন। তাই কখনো ঝাড়ুদার, কখনো দারোয়ান, টিকিটও বিক্রি করেন । আমি যখন জানতে চাইলাম, আপনি কেন পরে আছেন? পাল্টা তিনি বললেন, ‘কেন থাকব না। চল্লিশ বছর ধরে এখানে আছি। উনার বাবাও একই কাজ করতেন।‘ তার ভাষ্য মতে এইখান থেকে চাকরি করে তার ছেলেমেয়েকে খাইয়ে পড়িয়ে বড় করেছেন, এখন হলের ব্যবসা ভাল না দেখে চলে যেতে তিনি পারবেন না। মালিক নাকি নিজেই বলেছিলেন অন্য কোথাও চাকরি নিয়ে চলে যেতে । তবে উনার অভ্যাস হয়ে গেছে এখানে আসা । বেতন পান না আজ তিন মাস। তবুও নেই কোন অভিযোগ, নিরলস শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। কিছুক্ষণ আমি তাকে কোন প্রশ্নই করতে পারিনি । পরে তিনি নিয়ে গেলেন আমাদের একটা ঘরে যেখানে এনালগ সিস্টেমে রিলে সিনেমা দেখান হতো। আমার জন্য স্বপ্নের মত মনে হচ্ছিল সবকিছু।
রুচির পরিবর্তন, প্রযুক্তি, মন-মানসিকতার পরিবরতনের জন্য আজ আমাদের হল্গুলর এই করুণ পরিণতি। এই হল, সিনেমার সাথে কত শত মানুষের জীবন-জীবিকা, আবেগ অ ভালোবাসা জড়িয়ে আছে। সিনেমা হল এবং সিনেমার সাথে আমাদের নিছক বিনোদনের সম্পর্কই না, তার চেয়েও বেশি কিছু। আজ আর ভাল করে টের পেলাম।
* ব্যবহৃত ছবি ইন্টারনেট সূত্র হতে প্রাপ্ত। ছবিসত্ব আলোকচিত্রী দ্বারা সংরক্ষিত।