সিনেমাস্কোপ: আচ্ছা একজন প্রযোজক এর কাজ টা কি আসলে? বেশিরভাগ মানুষ মনে করে প্রযোজক হচ্ছেন যিনি টাকা দিচ্ছেন,বিষয় টা আসলে কত টুকু ঠিক?
মাহজাবিন রেজা : আসলে প্রযোজক মানে কি? যিনি উৎপাদন করেন,এটার সাথে আর্থিক একটা ব্যাপার অবশ্যই জড়িত থাকে,বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যিনি নির্বাহী প্রযোজক তিনি এই পুরো বিষয় টা দেখেন, আমাদের ইন্ড্রাস্ট্রিতে একজন প্রযোজক বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ধরনের কাজ করেন। যেমন বিজ্ঞাপনে প্রযোজকের কাজ একধরনের হয়,সিনেমায় আরেক ধরনের,আবার নাটকে আমরা আরেক ভাবে কাজ করি। নাটকে সাধারনত প্রযোজক পুরো টাকা টা আয়োজন করেন,এবং পুরো জিনিস টা কার্যকর করেন।
বিজ্ঞাপনে নির্বাহী প্রযোজক হিসেবে আমরা আসলে যেটা করি – প্রথমে স্ক্রিপ্ট টা আসে, ওই স্ক্রিপ্ট টা আসার পর যদি প্রযোজক এর একের অধিক পরিচালক থাকেন তাহলে তিনি সিদ্ধান্ত নেন কাকে দিয়ে কাজ টা করাবেন, তারপর একটা আনুমানিক খরচ ধরা হয়, তারপর আপনি প্রডাকশন এ যাবেন। তখন পরিচালক, সহকারি পরিচালক সবাই মিলে একটা মিটিং এ যায়, এর পর পুরো জিনিস টা আমরা লাইন প্রডিউসার এর কাছে দিয়ে দেই।
লাইন প্রডিউসার তখন পুরো জিনিসটা কার্যকর করেন, এবং প্রযোজক পুরো জিনিস টা দেখাশুনা করেন – যে সবকিছু ঠিক আছে কিনা, যেমন – এটার মধ্যে লোকেশন রেকি আছে, চিত্রনাট্য ঠিক আছে কিনা, শুটিং শেষে সেটার সম্পাদনা কোথায় হবে বাংলাদেশে নাকি ইন্ডিয়ায়? মিউজিক কে করবেন, সেটাও প্রযোজক ঠিক করেন, কারন একমাত্র তিনিই জানেন, তার কাছে কত অর্থ আছে, প্রযোজক এই সব রিক্রুট করেন, করে আবার লাইন প্রডিউসার কে দায়িত্ব দিয়ে দেন। পুরো জিনিসটা শেষ হলে তারপর প্রযোজক আবার সেটার উপস্থাপন করেন, এক কথায় কাজ আসা থেকে শুরু করে কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত প্রযোজক সবার সাথে যোগাযোগ করেন। সারা পৃথিবীতে প্রযোজকরা ঠিক এইভাবেই কাজ করে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে চরিত্র কিছুটা ভিন্ন, এইখানে প্রযোজক নির্ভর কাজ খুব কম হয়,এইখানে পরিচালক ই সব কাজ করে থাকেন। সিনেমার ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্ন সিনেমায় নির্বাহী প্রযোজক টাকা টা দেয়। আমাদের পরবর্তী যে সিনেমা সেইখানে নির্বাহী প্রযোজক হচ্ছেন একজন আমেরিকান, যিনি টাকাটা দিচ্ছেন, আর আমি এইখানে সহ প্রযোজক হিসেবে কাজ করছি
সিনেমাস্কোপ : যদি আমি প্রযোজক হিসেবে কাজ করতে চাই, কিন্তু আমার নিজস্ব কোন টাকা নেই, সেক্ষেত্রে আমি কিভাবে টাকা টা জোগাড় করব?
মাহজাবিন রেজা : প্রযোজক এর কাছে তো টাকা থাকে নাহ, টাকা থাকে ক্লায়েন্ট এর কাছে, আপনার কাজ হচ্ছে ডেলিভারি দেওয়া, সেটা আপনার নিজস্ব যোগ্যতায় অর্জন করতে হবে। যেমন ধরেন আপনি একটা সিনেমা বানাতে চান, আপনার কাছে একটা গল্প আছে, সেটা নিয়ে আগে আপনার একজন পরিচালক এর কাছে যেতে হবে, তারা সেটা বানাবে কিনা, না তারা তাদের পারিশ্রমিক না দিয়ে কিভাবে সেটা করে দিবে তা আপনার যোগ্যতার উপর নির্ভর করে। অথবা আপনার বড় বড় কোম্পানির কাছে যেতে হবে, তাদেরকে বলতে হবে আপনার কাছে একটা গল্প আছে, তারা তাদের অর্থ প্রদান করবে কিনা। আপনার যোগ্যতার প্রমান করতে হবে, যদি তারা আপনাকে ১০ টাকা দেয়, তাহলে আপনি তাদেরকে ১২ টাকা ফেরত দিবেন। জয়া আপা (জয়া আহসান) দেবী প্রযােজনা করে, সব জায়গায় অনেক সুনাম পাচ্ছেন। আমাদের দেশে, এখন অনেক মেয়ে প্রযােজক হিসেবে কাজ করছে। বাইরের দেশেতাে প্রচুর মেয়ে কাজ করছে এবং অন্য অনেকের থেকে অনেক দক্ষতার সাথে এবং অনেক যত্ন নিয়ে কাজ করছেন। বর্তমানে, আমাদের দেশের মেয়েরাও অনেক আগ্রহী। আমি ব্যক্তিগতভাবে নারী-পুরুষ আলাদা করে দেখি না।
সিনেমাস্কোপঃ এবার একটু পিছনে যাই, প্রযোজক হিসেবে আপনার ভ্রমণের শুরুটা যদি একটু বলতেন।
মাহজাবিন রেজাঃ ২০০০ সালের দিকে অমিতাভ ভাইয়া (অমিতাভ রেজা) প্রোডাকশন হাইজ শুরু করে,শুরুর দিকে আমি প্রযোজক হিসেবে কাজ শুরু করিনি। তখন আমাদের অন্য একজন নির্বাহী প্রযোজক ছিলেন। ভাইয়া আমাকে বলেন, তুমি যেহেতু কস্টিউম বুঝো তাহলে সেটা নিয়েই কাজ করো।তখন, আমাদের একজন আর্ট ডিরেক্টর ছিলেন রঞ্জন রাব্বানি। আমি তার সাথে কাজ করতাম। ২০০১ বা ২০০২ এর দিকে আমাদের নির্বাহী প্রযোজক চলে যায়। তখন ভাইয়া আমাকে টাকা-পয়সা বিল এই ব্যাপারগুলো দেখার জন্য বলেন। তখন আমি ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে মাত্র ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। প্রথমে, কাজটা বোঝার জন্য লাইন প্রডিউসার হিসাবে কাজ শুরু করি। তারপর, আস্তে আস্তে প্রযোজক হিসেবে কাজ শুরু করি।
সিনেমাস্কোপঃ ১৭ বছরের দীর্ঘ যাত্রা। নিজের কাজটাকে উপভোগ করেছেন?
মাহজাবিন রেজাঃ আসলে, সত্যি বলতে কি ব্যাপারটা এখন কিছুটা হতাশাজনক। কারণ- এখন আমাদের সামনে অনেক বাধাঁ আছে। অনেক বাধাঁ পার করে কাজটা করতে হয়। এখন প্রচুর প্রতিযোগিতা আছে কিন্তু সেটাও ঠিক আছে। সমস্যা হচ্ছে, আমাদের কাজের মধ্যে অনেক ধরনের চাপ চলে এসেছে। যেমন- আগে কাজে প্রাধান্য দেওয়া হত আর এখন কত মুনাফা হবে সেটাতে প্রাধান্য দেওয়া হয়। অন্যদিকে, ধরুন আপনি একটি চমৎকার বিজ্ঞাপন বানালেন, সেটা থেকে আপনি মুনাফাও করলেন। কিন্তু ৬ মাস পরে মানুষ সেটা মনেও রাখবে না। কিন্তু আপনি যদি একটা ফিকশন করেন, ওটার জন্য মানুষ আপনাকে মনে রাখবে। বিজ্ঞাপন করা হয় পেটের তাড়নায়, কারণ- একটা ফিকশন করে আপনি অত মুনাফা করতে পারবেন না কিন্তু মনের শান্তি আসবে। এই কারণে অব্যশই উপভোগ করি, কিন্তু আবার অনেক সময় হতাশাও হয়।
সিনেমাস্কোপঃ বর্তমান সময়ে, আমাদের সমাজ বা ইন্ডাস্ট্রিতে নারী প্রয়োজকের অবস্থাটা কোথায়?
মাহজাবিন রেজাঃ সত্যি বলতে, আমি আলাদাভাবে দেখি না। আমাদের জয়া আপা (জয়া আহসান) দেবী প্রযোজনা করে, সব জায়গায় অনেক সুনাম পাচ্ছেন। আমাদের দেশে, এখন অনেক মেয়ে প্রযোজক হিসেবে কাজ করছে। বাইরের দেশেতো প্রচুর মেয়ে কাজ করছে এবং অন্য অনেকের থেকে অনেক দক্ষতার সাথে এবং অনেক যত্ন নিয়ে কাজ করছেন। বর্তমানে, আমাদের দেশের মেয়েরাও অনেক আগ্রহী। আমি ব্যক্তিগতভাবে নারী-পুরুষ আলাদা করে দেখি না।
সিনেমাস্কোপ: এখন অনেকেই প্রযোজক হিসেবে কাজ করছেন। কিন্তু ১৭ বছর আগে কতখানি চ্যালেজিং ছিল?
মাহজাবিন রেজা: অবশ্যই শুরুতে আমাদের জন্য প্রচুর চ্যালেঞ্জিং ছিল। আমাদের পর্যাপ্ত পরিমানে বাজেট ছিল না। তারপরেও আমরা কখনো গুণগত মান নিয়ে আপস করিনি।
সিনেমাস্কোপ: এখন পর্যন্ত, নিজের কোন কাজটিকে শ্রেষ্ঠ মনে করেন?
মেহজাবিন রেজা: অনেক তো! কোনটা রেখে কোনটা বলবো! অবশ্যই সর্বপ্রথমে, আয়নাবাজির নাম নিব। তারপর, নাটকের ক্ষেত্রে হাওয়া ঘর। বিজ্ঞাপনতো আমরা অনেক করেছি, কিভাবে বলি! গ্রামীণফোনের, বন্ধু কই গেলা রে। অনেক আগে, আশফাকুল জামান বিপুলের সাথে কংকা টিভির একটা টিভিসি করেছিলাম। গ্রামীণফোনের একটা কাজ ছিল, সেটাতে তানভীর আহসানের সাথে কাজ করি। তিনি রবির শেষ চারটা বিজ্ঞাপনের কাজ করেছেন, ঐগুলো আমার কাছে বেশ ভালো লেগেছে। সেখানে, তানভীর চরিত্র নিয়ে বেশ খেলেছেন। আর বাংলালিংকের যে তিনটা কাজ করেছিলাম সেগুলো এছাড়াও ফখরুদ্দিন বাবুর্চি, আজাদ প্রোডাক্টের কাজগুলো খুব ভালো ছিল। ঐ রকম কাজ এখন আমরা করতে পারছি না।
সিনেমাস্কোপঃ কেন? মাহজাবিন রেজাঃ সত্যি কথা বতে ঐ ধরনের গল্প আর এখন আসে নাহ। গল্পগুলো এখন অনেক বেশি কৃত্তিম। আপনি যদি আগের গল্পগুলো দেখেন, আর এখনকার গল্পগুলো দেখেন, দেখবেন- বিষয়বস্তু দূর্বল।
সিনেমাস্কোপঃ বিষয়বস্তু আগের থেকে অনেক দূর্বল, এই যে পরিবর্তন আপনার কাছে এর পিছনের কারণ কি মনে হয়
মাহজাবিন রেজাঃ প্রথমত, মানুষ আসলে ঐভাবে বিজ্ঞাপন করেই নাহ। কারণ, একটা বিজ্ঞাপন করতে বিজ্ঞাপন দাতার যে খরচ হয়, তার থেকে অনেক কম খরচ হয় সে যদি কন্টেন্ট নিয়ে কাজ করে। দ্বিতীয়ত আমার মনে হয় – ক্রিয়েটিভ বিভাগ এখন কিছুটা দূর্বল। যদিও এখনো কিছু ভালো কাজ হচ্ছে। যেমন, ফারুকি (মোস্তফা সারোয়ার ফারুকি) ভাই এখনো বেশ মজার কাজ করছেন। সান কমিউনিকেশনের তানভীর ভাইয়ের গল্পগুলোও ভালো হয়। তবে আগে যেমন- গল্প বলায় বেশী প্রাধান্য দেয়া হত, এখন সেটা আমরা অনেক বেশি পন্যের উপর দিচ্ছি।
সিনেমাস্কোপঃ চলচ্চিত্র প্রযোজনা নিয়ে আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি?
মাহজাবিন রেজাঃ আগামী বছর, আমরা একজন আমেরিকান প্রডিউসারের প্রজেক্ট করতে যাচ্ছি। তারপরেও আমাদের আরো দুই তিনটি প্রজেক্ট আছে, দেখা যাক কি হয়।
সিনেমাস্কোপঃ আমরা যদি, আমাদের পাশের দেশের সাথে নিজেদের তুলনা করি, তাহলে বর্তমানে আমাদের অবস্থানটা কোথায় আছে?
মাহজাবিন রেজাঃ আমি আসলে ঐভাবে তুলনা করে বলতে পারবো ন। তবে, তারা খুব ভালো করে জানে কিভাবে কাজটি করতে হয়। তারা অবশ্যই অনেক দক্ষ এবং অনেক বেশী পেশাদার। তারা আমাদের মতো ফাঁকিবাজ না, আমরা মনে হয় একটু ফাঁকিবাজ। কারণ, তাদের জানার অনেক সুযোগ আছে, তাদের অনেক রকমের কোর্স আছে, অনেক প্রতিষ্ঠান আছে শেখার এবং সবচাইতে বড় কথা অনেক কাজের ক্ষেত্র আছে, যেটা আমাদের এখানে অনেক কম।
সিনেমাস্কোপ: আমাদের সিনেপিডিয়ার এবারের বিষয়বস্তু হচ্ছে, সিনেমায় নারীদের অংশগ্রহন। আপনি কিভাবে তাদের উৎসাহিত করবেন সিনেমায় অংশগ্রহণ করার জন্য?
মাহজাবিন রেজা: আমি তাদের বলবো, কাজকে কাজ হিসেবে দেখতে। সর্বপ্রথম, নিজের লক্ষ্যটাকে ঠিক করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমি যে কাজটা করবো সেটা আর্টিস্ট হতে পারে, প্রযোজক, সম্পাদক বা সহকারীও হতে পারে। আর একটি কথা বলবো, যে ক্ষেত্রেই কাজ করুক না কেন, কাজটা প্রথমে শিখে আসতে। আমি যদি কাজটা না পারি বা ন্যূনতম আগ্রহ না থাকে তাহলে কাজটা করা ঠিক হবে না। আমি মনে করি, অবশ্যই মেয়েদের সিনেমায় আসা উচিত, তারা ছেলেদের চাইতে অনেক বেশী নিখুঁত ভাবে কাজ করতে পারে।
সিনেমাস্কোপ: আপনার কাছে আমাদের শেষ প্রশ্ন। আপনার দীর্ঘ ১৭ বছরের অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে, যদি বলেন, একজন প্রযোজকের যদি নির্দিষ্ট কিছু গুণ থাকতে হয় তাহলে সেগুলো কি হবে?
মাহজাবিন রেজা: প্রথমত, সততা থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রতিশ্রুতিতে খুব পাকা হতে হবে। তৃতীয়ত, আবারও সততা থাকতে হবে। আপনি যেটা বলবেন সেটা করতে হবে এবং যেটা বলবেন, করবেন, সততার সাথে করতে হবে। তাহলে আমার মনে হয় না আর কিছুর প্রয়োজন আছে।
সিনেমাস্কোপ: আপনার মূল্যবান সময় থেকে আমাদের কিছু সময় দেয়ার জন্য, আপনাকে ধন্যবাদ।
মাহজাবিন রেজা: আপনাদেরকেও অনেক ধন্যবাদ।
ছবিসত্ব: দেখোপিডিয়া ইউটিউব কন্টেন্ট থেকে সংগৃহীত। দেখোপিডিয়া কর্তৃক সংরক্ষিত